নিউজ ডেস্ক : যুবদল নেতার স্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করার জেরেই রাজশাহী বিশ্ববিধ্যালয়ের অধ্যাপক ড. একেএম শফিউল ইসলাম খুন হয়েছেন বলে দাবি করছে র‌্যাব।

র‌্যাব বলছে, ঘটনার সূত্রপাত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ও রাজশাহী জেলা যুবদলের সদস্য আব্দুস সামাদ পিন্টুর স্ত্রী নাসরিন আক্তার রেশমার সঙ্গে শফিউল ইসলামের অসৌজন্যমূলক আচরনের মধ্যে দিয়ে।

এই খুনের ঘটনায় আটককৃতরা হত্যার কথা স্বীকার করে এমন তথ্য দিয়েছে। তবে হত্যাকাণ্ডের পর ফেসবুকে দায় স্বীকার করে ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামে যে সংগঠনটি বার্তা প্রকাশ করা হয় তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন তারা। ফলে তাই এই বার্তা ও দায় স্বীকার নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের।

র‌্যাব জানিয়েছে, এই খুনের মিশনে অংশ নিয়েছিল ১১ জন। এদের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- রাবি ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি আব্দুস সামাদ পিন্টু, কাঁটাখালী পৌর যুবদলের সাংগাঠনিক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম মানিক, ইব্রাহিম খলিল বাবু, সবুজ শেখ, আল মামুন ও সিরাজুল ইসলাম কালু। আরিফ, সাগর ও জিন্নাহ পুলিশের হাতে আগেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই খুনের নির্দেশদাতা রাজশাহী জেলা যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল ও যুবদল নেতা হুন্ডি ব্যবসায়ী জামাই বাবু পলাতক রয়েছেন।

শনিবার রাতে রাজশাহী ও গাজীপুরের টঙ্গীতে অভিযান চালিয়ে এই ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাদের কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি, ছুরি ও হাসুয়া উদ্ধার করা হয়েছে।

রবিবার গ্রেপ্তারকৃত ৬ জনকে র‍্যাব সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন- র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান, গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার মাহমুদ খান, উপ-পরিচালক মেজর রুম্মন ও সহকারী পরিচালক ক্যাপ্টেন মাকসুদ।

ঘটনার সূত্রপাত
আব্দুস সামাদ পিন্টুর স্ত্রী নাসরিন আক্তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনে হিসাব শাখার সেকশন অফিসার। রেশমার সঙ্গে অধ্যাপক শফিউলের বেশ কয়েকবার অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য পিন্টু রাজশাহী জেলা যুবদলের আহ্বায়ক ও রাবি ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলের দারস্থ হন। পরে উজ্জ্বলের নেতৃত্বে বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উজ্জ্বল বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে অধ্যাপক শফিউলের সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতে দু’জনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর তারা অধ্যাপক শফিউলকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য রাজশাহীর কাঁটাখালী পৌর যুবদলের সাংগাঠনিক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম মানিকের নেতৃত্বে খুনের অপারেশন পরিচালিত হয়।

হত্যার পরিকল্পনা
২০০৩ সালের রাবি ছাত্রদল শাখার সহসভাপতি হন আব্দুস সামাদ পিন্টু। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৪৪ জন কর্মচারীর গণনিয়োগ হয়। পিন্টুর স্ত্রী নাসরিন আক্তার রেশমা প্রশাসন ভবনের হিসাব শাখার সেকশন অফিসার নিয়োগ পান। রেশমা মতিহার থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিনের ভাতিজি।

র‌্যাবের মিডিয়া অ্যান্ড লিগ্যাল শাখার পরিচালক কমান্ডার মাহমুদ খান বলেন, ঘটনার ১০/১৫ দিন আগে পিন্টুর স্ত্রী নাসরিনের সঙ্গে অধ্যাপক শফিউল অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এ নিয়ে পিন্টুর সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। পিন্টু শিক্ষককে শায়েস্তা করার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলা যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলের কাছে ক্ষোভের কথা জানান। উজ্জ্বল বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক অধ্যাপক শফিউলের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তাদের মধ্যেও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় এবং উজ্জ্বল নিজেও অপমানিত বোধ করেন। উক্ত শিক্ষককে সায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন। ঘটনার ৮/১০দিন আগে একটি চায়ের দোকানে মানিক, উজ্জ্বল ও পিন্টু চা খায়। সেখানে পরিকল্পনা হয় অধ্যাপক শফিউলকে শায়েস্তা করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ি উজ্জ্বল ও পিন্টু তারই পরিচিত কাঁটাখালী পৌরসভার যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মানিককে দায়িত্ব দেয়।

যেভাবে হত্যা করা হয়
গত ১৫ নভেম্বর দুপুর আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেসরকারি আবাসিক এলাকা বিহাস সংলগ্ন চৌদ্দপায়া এলাকার আতাউরের বাড়ির পার্শ্বে কাঁচা রাস্তার উপর মানিক অধ্যাপক শফিউলকে রাস্তায় বাধা দেয়। বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে সবুজ শেখ শিক্ষকের মাথায় চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। সবুজের চাপাতির কোপে শিক্ষক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঘটনার পর পিন্টু ও মানিক এই কোপ দেয়ার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু এই প্রতিবাদের পরও যখন তারা দেখতে পায় যে স্যার তাদের চিনে ফেলেছে তখনই মামুন, আরিফ, বাবু ও কালু চাপাতি, হাসুয়া ও চাকু নিয়ে অধ্যাপক শফিউলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

র‌্যাব সদর দফতরে সাংবাদিক সম্মেলনে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মামুন জানান, এ কাজের জন্য সে কোন টাকা পায়নি। শুধুমাত্র বড় ভাই ও জেলা যুবদলের আহবায়ক বলেছে। সেও যুবদলের রাজনীতি করে। সে কারণে বড় ভাইয়ের কথামত এ কাজ করেছে। তাদের স্যারকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল না। গ্রেফতারকৃত যুবদল নেতা মানিক জানান, এই কিলিং মিশনে অংশ নেয়া সাগর ব্যাটারিচালিত গাড়ি চালায় ও রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারন সম্পাদক, আরিফ টাইলস মিস্ত্রী ও কাটাখালী পৌরসভার যুবদলের সদস্য, জিন্নাহ যুবদলের সদস্য, বাবু ব্যাটারি চালিত গাড়ি চালায় ও যুবদলের সদস্য, মামুন তার চাচাতো ভাই, জামাই বাবু মাছের ব্যবসা করেন, কালু মুদির দোকানদার ও যুবদল সদস্য ও সবুজ যুবদল সদস্য।

যে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি
যুবদলের নেতাকর্মীদের পরিকল্পনায় অধ্যাপক শফিউল খুনের ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পায়নি র‌্যাব। র‌্যাবের কর্মকর্তা কমান্ডার মাহমুদ খান বলেন, ‘ব্যক্তিগত অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনার জের ধরেই অধ্যাপক শফিউল খুন হয়েছেন। কিন্তু ওই খুনের ঘটনার পর আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন হত্যার দায় স্বীকার করে ফেসবুকে বিবৃতি দেয়। এই ফেসবুকে কে দায় স্বীকার করলো-তা নিয়ে এখনও র‌্যাব ও পুলিশ তদন্তের কোনো কুল কিনারা করতে পারেনি।

(ওএস/অ/নভেম্বর ২৪, ২০১৪)