সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো অনৈতিক ও গর্হিত কাজ
মোহাম্মদ ইলিয়াছ
সাধারণ বিবেচনায় গুজব ছড়ানো অত্যন্ত অনৈতিক ও গর্হিত কাজ। এটি সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সহানুভূতির নীতিকে লঙ্ঘন করে। যে সমাজ নৈতিক ও দায়িত্বশীল কমিউনিকেশনকে মূল্য দেয়, সেখানে গুজব ছড়ানো একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের নীতির বিরুদ্ধে যায়। অনেক সময় গুজব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং তা অনিচ্ছাকৃত পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়ে শত্রুতা উসকে দিতে পারে, দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে। সর্বোপরি মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ফলে আইনি পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। কেননা, সাইবার স্পেসে মিথ্যা তথ্য বা গুজব প্রতিরোধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক সুবিধা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে ভুয়া খবর তৈরি করা হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। সেই খবরের সত্যতা ও সূত্র যাচাই না করে তা প্রচার করছে ফেসবুক-টুইটার ব্যবহারকারীরা। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সমাজে। নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা এমনকি ভয়াবহ রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটে গেছে গুজব ছড়ানোর কারণে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের হাতে হাতে ফেসবুক-টুইটারের মতো শক্তিশালী যোগাযোগের মাধ্যম রয়েছে। এর অপব্যবহার হলে তাই কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে আমাদের আইনে।
প্রযুক্তির কল্যাণে ইন্টারনেট এখন সবার হাতের নাগালে। যার সুবাদে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের ব্যবহার বেড়েই চলছে। আবার এই ফেসবুকের অপব্যবহার করে অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে। বিভিন্ন বিষয়ে অপপ্রচার, গুজব রটানো, আপত্তিকর, মানহানিকর, আক্রমণের উদ্দেশ্যে ছবি ও ভিডিও পোস্ট শেয়ার করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বাথের্ ফেসবুকের অপব্যবহার হচ্ছে। যা স্পষ্টত সাইবার অপরাধ। অনেকেই কিন্তু জানেন না ফেসবুকের সঠিক ব্যবহার। অজানাবশত কিংবা কী করা বৈধ আর কী কী করা অবৈধ সেটা না জানার কারণে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে মনের অজান্তে। ফেসবুক ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন ও সতকর্ থাকার কোনো বিকল্প নেই। একটু ভুলের কারণে আপনি আসামি হতে পারেন সাইবার অপরাধের অভিযোগে। সাইবার অপরাধীর বিচারে দেশে কঠিন আইন রয়েছে। জেনে বা না জেনে, যদি কেউ ফেসবুক ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো অপরাধ করে তাহলে এর জন্য ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। এবং মামলাও হচ্ছে। মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) অনুসরণ করা হয় সাইবার ক্রাইমের সম্পকির্ত অপরাধের জন্য। তাই আসুন জেনে নিই, কখন কী করলে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা অনলাইনে সাইবার অপরাধ হয়।
ফেসবুক বা যে কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা কোনো গণমাধ্যমে এমন কিছু লেখা বা পোস্ট করা বা স্ট্যাটাস দেয়া বা মন্তব্য করা কিংবা ছবি বা ভিডিও আপলোড করা- যা মানহানিকর, বিভ্রান্তিমূলক, অশালীন, অরুচিকর, অশ্লীল, আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে হয় তা ‘সাইবার অপরাধ’ বলে বিবেচিত হবে। আবার অনলাইন ব্যবহারে এমন কোনো কিছু করা যাতে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে; লিঙ্গ, জাতি, ধমর্, জাতীয়তা, যৌনতা ইত্যাদি উল্লেখ বা ইঙ্গিত করে কুৎসা রটানো কিংবা মানহানিকর, অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে সবই ‘সাইবার অপরাধ’। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে অনলাইনে ভীতি বা শক্তি প্রদশর্ন করা, হুমকি দেয়া বা কোনো কিছু পাঠানো অথবা মিথ্যা তথ্যসংবলিত বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য অপপ্রচার করলেও ‘সাইবার অপরাধ’ হবে।
দেশে অরাজক ও অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করতে, রাষ্ট্রের ভাবমূতির্ ক্ষুণ্মহয় বা সম্ভাবনা আছে এ রকম যে কোনো কমর্কান্ডকিংবা দেশবিরোধী কোনো কিছু অনলাইনে করলে তাও সাইবার অপরাধ হবে। এ ছাড়া অনলাইনে কারও নামে ভুয়া একাউন্ট খুললে বা হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে, তথ্য চুরি করলে কিংবা ইলেকট্রনিক কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলে ‘সাইবার অপরাধ’ হবে। সাইবার অপরাধ হয় এ রকম কোনো পোস্ট বা স্ট্যাটাস বা মন্তব্য বা ছবি বা ভিডিও শেয়ার, লাইক, কিংবা ট্যাগ দিলেও ‘সাইবার অপরাধ’ হতে পারে। অথার্ৎ অনলাইনে ইচ্ছাকৃতভাবে যে কোনো অপরাধমূলক কমর্কান্ড যা কেউ পড়লে বা দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, যার মাধ্যমে মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূতির্ ক্ষুণ্ণ হয় বা ধমীর্য় অনুভ‚তিতে আঘাত করা বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করাসহ সবই ‘সাইবার অপরাধ’ বলে বিবেচিত হবে।
আইন লঙ্ঘনে বিচার প্রক্রিয়া ও শাস্তি : অনলাইন ব্যবহার করে কেউ কোনো অপরাধ করলে সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থানায় অভিযোগ করতে পারে। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টিমের পযের্বক্ষণে যদি অপরাধ হয়েছে বলে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে তাহলে অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেবে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কমর্কতার্ তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অবহিত করে মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করতে পারবেন। পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) ছাড়াও গ্রেপ্তার করতে পারে। এ অপরাধ কিন্তু জামিন-অযোগ্য। কোনো অপরাধী, ব্যক্তি বা সংগঠনের ফেসবুক, স্কাইপ, টুইটার বা ইন্টারনেটের যে কোনো মাধ্যমের অপরাধ-সংশ্লিষ্ট আলাপ-আলোচনা ও কথাবাতার্ অথবা অপরাধ-সংশ্লিষ্ট স্থির ও ভিডিওচিত্র অপরাধের আলামত হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদালতে উপস্থাপন করতে পারবেন। এবং আদালতে আমলযোগ্য হবে। অথার্ৎ সাক্ষ্য আইনে যাই থাকুক না কেন, মামলার স্বাথের্ তা আদালতের গ্রহণযোগ্য হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩)-এর ৫৭ (দুই) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধ করলে তিনি শাস্তি সবোর্চ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং সবির্নম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ১ কোটি টাকা পযর্ন্ত অথর্দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
ফেসবুক বতর্মানে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নানা সামাজিক প্রতিবাদে সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনাতেই ইতিবাচক ভুমিকায় ব্যবহার করা হয়েছে। আবার অনেক সময়ই ফেসবুক ব্যবহার করে নানা ভুল তথ্য, ছবি ও গুজব ছড়ানো হয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকার আছে সবার। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। আইন মেনেই করতে হয়। অনলাইনে মতপ্রকাশের সময় এই দায়িত্ববোধ রয়েছে। সুতরাং ফেসবুক ব্যবহারে এমন সতকর্তা ও দায়িত্বশীল হতে হবে, যাতে একটি পোস্ট বা মন্তব্য যেন আইন লঙ্ঘন না করে। কারণ ফেসবুক কেন্দ্র করে ৫৭ ধারায় প্রচুর মামলা হয়। আসুন, ফেসবুকের যথাযথ ব্যবহার করি
যে কোনো তথ্যকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করার আগে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করার আগে বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে এবং ফ্যাক্ট চ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সর্বদা তার বিশ্বাসযোগ্য সূত্র যাচাই করে দায়িত্বশীল শেয়ার করতে হবে। পাশাপাশি তার পেছনে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর স্বার্থ আছে কি না, তা যাচাই করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু তথ্য সত্য, কিন্তু তা প্রকাশ পেলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মাঝে মতভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকা উচিত।
লেখক : উপপরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।