আবীর আহাদ


এবার যাত্রা হলো শুরু। কিন্তু যাত্রা শুরুর লগ্নে ছিল না কোনো দেশের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক। দেশী ও বৈদেশিক তহবিল একেবারে শূন্য। আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকিবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা দেশী-বিদেশী মুদ্রা ও রিজার্ভের সোনাদানা লুটপাট করে নিয়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধানতম তিনটি উপায় পাট চা ও চামড়া গুদামে অগ্নিসংযোগ করে। অর্থাত পাকিবাহিনী ও তার সহযোগী রাজাকার দালালগোষ্ঠী তাদের পরাজয় অবধারিত জেনে স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে সহজে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য যাবতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাবলীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। অপরদিকে দীর্ঘ দশটি মাসে যুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে কৃষকরা কোনো ফসল উৎপন্ন করতে পারেনি।

অপরদিকে আকাশ নৌকা ও স্থল পথ অচল ও বিধ্বস্ত।হাজার হাজার রাস্তাঘাট শহর বন্দর গঞ্জ হাট বাজার গ্রামসহ পুল-কালভার্ট-ব্রীজ সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত। শিল্প-কলকারখানা বিধ্বস্ত। পাকিবাহিনী কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত অবাঙালি মালিকদের ফেলে যাওয়া শিল্প-কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিয়ে সমস্যাসহ এসবের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনর্বাসনের সমস্যা। সরকারি অফিস-আদালতের অব্যবস্থাসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সমস্যা।প্রশাসনযন্ত্র বিপর্যস্ত। আনসার পুলিশ বিডিআর ও সামরিক বাহিনী বিপর্যস্ত। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা বিধস্ত। ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী স্বদেশাগত এককোটি ছিন্নমৃল মানুষের পুনর্বাসনের সমস্যা। ভিন্ন মতাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধা, চোর-ডাকাত ও রাজাকারদের হাতে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের সমস্যা। পালিয়ে ও লুকিয়ে থাকা রাজাকার আলবদর ও চোর-ডাকাতদের হাতে ছড়িয়ে থাকা বিপুল অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারসহ সাঁইত্রিশ হাজার পাকিদালালদের নিয়ে সমস্যা। দেশে তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিসহ সাত লক্ষ অবাঙালিদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর সমস্যা। পাকিস্তানে আটকে-পড়া পাঁচ লক্ষ বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর বাঙালিদের দেশে ফিরিয়ে আনার সমস্যা। বাংলাদেশের মাটিতে লক্ষাধিক ভারতীয় মিত্রবাহিনী অবস্থান। কৃষকদের বীজ, চারা, চাষাবাদের যন্ত্রপাতি ও হালের বলদজনিত সমস্যা, তাদের খাওয়া-পরা মেটানোর সমস্যাসহ ইত্যাকার হাজারো সমস্যা-শংঙ্কুল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার দুরূহ দায়-দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশের হাল ধরলেন।

দেশবাসীর খাদ্য বাসস্থান শিক্ষা চিকিত্সা কর্মসংস্থান ও সার্বিক আর্থসামাজিক পুনর্বাসনের মহাসাগরসম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মবিশ্বাস ও দেশবাসীর ওপর প্রবল আস্থাকে সম্বল করে অগ্রসর হতে থাকলেন। এ-অবস্থার মধ্য দিয়েও অবাধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রচলন করলেন। দেশকে একটি গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে মাত্র ন'মাসের মধ্যে তিনি জাতিকে একটি শাসনতন্ত্র উপহার দিলেন। দেশ পরিচালনার মূল লক্ষ্য হিশেবে চারটি মৌলিক আদর্শ গ্রহণ করা হলো যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সার্বিক ফলশ্রুতি, যথা : গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপক্ষেতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূল আদর্শের বাস্তবায়ন এবং বিশ্বরাজনীতিতে মুজিবের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের সমাজতান্ত্রিক ও জোটনিরপেক্ষ শিবিরে অবস্থান ইত্যাদি বিষয়াবলীতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন বৈরিতার রেশ ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন সৌদি আরবসহ পুঁজিবাদী বিশ্ব এবার অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে অর্থই হলো এর কার্যকরি সমাধান, এ-স্তরে মার্কিন সমর্থিত পুঁজিবাদী বিশ্ব বাংলাদেশের সাহায্যের মধ্যে নিত্যনতুন শর্তারোপ ও বিভিন্ন প্রকার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এমনকি জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় সৌদি-মুসলিম বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক গণচীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রবল বাধার প্রাচীর গড়ে তোলে। তারা মূলত: পাকিস্তানের হীনস্বার্থে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পুনরায় অবস্থান গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সাহায্য-সহযোগিতা থেকে বাংলাদেশ নিদারুণভাবে বঞ্চিত হতে থাকে।

এ-অবস্থায় ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশ, বিভিন্ন মানবতাবাদী সাহায্য সংস্থা, জাতিসংঘের ত্রাণবিভাগ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস সমিতিসহ কতিপয় বন্ধুভাবাপন্ন দাতাদেশ যৎসামান্য সাহায্য সামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়। এই যৎসামান্য সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে এক অনিশ্চয়তার ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে হলো। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন, পাকিস্তান ও সৌদির গোপন সাহায্যে বলিয়ান হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, পাকিপন্থী মোল্লা-মৌলভী, তথাকথিত সর্বহারা পার্টিসহ আরো কতিপয় চৈনিকপন্থী গোপন রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের এদেশীয় পরাজিত দালাল রাজাকার আলবদরদের সেসব দলে স্থান দিয়ে দল ভারি করে এবং ঐসব স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে একজোট হয়ে জনপ্রিয় মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে জাতীয় সমস্যাসমূহকে আরো মারাত্মক ভারাক্রান্ত করে তুলতে থাকে। এতকিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবর্ণনীয় সমস্যাসমূহের পরও পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করা হয় যা রক্তাক্ত বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধের পরে কোনোকালে কোনোদেশে কখনো দেয়া হয়নি। অথচ বঙ্গবন্ধু তার ব্যতিক্রম। তিনি সকলকে পূর্ণভাবে মুক্ত গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার অধিকার প্রদান করেছিলেন। এদিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

এই বিশাল ও ব্যাপক রাজনৈতিক জনযুদ্ধ সাধারণ মানুষের সকল চেতনাকে বিকশিত ও আলোকিত করে প্রখর করেছে। সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে খুবই সচেতন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধকালীন জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাচেতনা ও সমাজতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক মানসিকতার উন্মেষে গোটা জাতি উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে বাঙালি জাতি কিছু সময়ের জন্যে হলেও তাদের মনের সকল কালিমা অন্ধত্ব ও কুসংস্কারকে বিসর্জন দিতে সক্ষম হয়। ফলশ্রুতিতে জাতীয় সার্বিক কর্মকাণ্ডে জাতি তাদের ভূমিকা পালনের জন্য তৎপরতা হয়ে ওঠে। কিন্তু জাতীয় আর্থসামাজিক দুরাবস্থা ও বিপর্যয় তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

অপরদিকে বিভিন্ন সাহায্যদাতা দেশ ও সংস্থাসমূহ তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দর্শন ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে সাহায্যদানের পূর্বশর্ত হিশেবে গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। প্রচলিত ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিণতি সাধারণ মানুষের জীবনকে কীভাবে শোচনীয় বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত করে তার নিদারুণ অভিজ্ঞতা পাকিস্তান কাঠামোয় আবদ্ধ বাঙালি জাতি উপলব্ধি করতে পেরেছে। এ-অবস্থাকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসন ব্যবস্থায় গ্রহণ করলেন সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ। ব্যাপক জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তাদের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে তাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিশেবে সকল প্রকার ব্যাঙ্ক, বীমা, বৃহত্ শিল্প-কলকারখানা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বৈদেশিক ব্যবসা- বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিত্সা প্রভৃতি জাতীয়করণ করে জনগণের মালিকানায় ন্যস্ত করলেন। শোষণের অন্যতম ক্ষেত্র ভূমিব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করে পরিবার প্রতি একশত বিঘা জমির সিলিং বেঁধে দিয়ে অতিরিক্ত ও সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বন্টন করে দেন। কৃষি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণসহ শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতনের তারতম্যের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথা: খাদ্য কৃষি বিদ্যুত্ ওয়াসা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডসহ শিক্ষা ও চিকিত্সা খাতে সরকারি ভর্তুকি প্রদান করলেন। বঙ্গবন্ধু এভাবেই জনজীবনের সর্বত্র একটা সমাজবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশী-বিদেশী শোষণের বিষদাঁত উপড়ে ফেলার কার্যক্রম গ্রহণ করলেন।

(চলবে)

লেখক : মুক্তযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বহু গ্রন্থের লেখক।