এম আর ইসলাম


বাংলাদেশ সংবিধানের ত্রুটি থেকে গেছে সেই Proclamation of Independence, 1971 (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ১৯৭১) থেকে। স্বাধীনতার ক্রান্তিকালে এই সাময়িক সাংবিধানিক দলিল একচ্ছত্রভাবে রাষ্ট্রপ্রধানকে যাবতীয় ক্ষমতা অর্পণ করে। যদিও সময়ের বিবেচনায় অনেকেই এমন সাময়িক আইনি কাঠামো মেনে নিয়েছিল, কিন্তু এর জের স্বাধীনতা পরবর্তী সংবিধান ও তার বিভিন্ন সংশোধনীতে থেকে যায়। যে সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই নিজেদের ক্ষমতা সাংবিধানিকভাবে বাড়িয়ে নিয়েছে। গণতান্ত্রিক বা সামরিক, উভয় প্রকার সরকারই ক্ষমতা বাড়িয়ে নিতে বা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে সংবিধানের সার্জারি করেছে যথেচ্ছভাবে। ভাগ্য ভালো যে আগের কিছু সাংবিধানিক সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছে বটে, কিন্তু বেশ কিছু সংশোধনীর বিষয়বস্তু যথেষ্ট বৈপরীত্য নিয়ে এখনও টিকে আছে। 

আমাদের দেশে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিসেবে, প্রধানমন্ত্রী যাবতীয় ক্ষমতার মালিক হয়ে আছে বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোতে, যা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। কমন’ল-এর দেশগুলোর আলোকে সংসদীয় গণতন্ত্র এ দেশে চর্চা করা হলেও সংসদকে কার্যকর করার বা জবাবদিহিমূলক নির্বাহী/ক্যাবিনেট রাখার চেষ্টা সংবিধান প্রণেতারা খুব একটা দেখাননি।

প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক করার পাশাপাশি, এই সংবিধান যেনতেনভাবে নির্বাচন করার ব্ল্যাঙ্কচেক দেয়, যা গণতন্ত্রের সঙ্গে এক নির্মম তামাশার শামিল। এ দেশের রাজনীতিকরা সংবিধানের আক্ষরিক ব্যাখ্যা বলবৎ রাখতে চান, কিন্তু অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবনে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের খানিকটা অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।

মাত্র সাত মাসে করা ১৯৭২-এর সংবিধান সময়ের বিবেচনায় পাস করেছিল। কারণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাংবিধানিক সরকারের কোনও বিকল্প ছিল না। স্বাধীন হবার ১০ বছর পরও সংবিধান তৈরি করতে না পারার যে ব্যর্থ ইতিহাস ছিল পাকিস্তানের, তা নব্য স্বাধীন বাংলাদেশকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংবিধান তৈরি করতে প্রণোদিত করেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদের লেজিটিমেসি নিয়ে রাজনৈতিক প্রশ্ন ছিল বটে, কিন্তু দুর্বলতা ছিল নতুন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সংবিধান রচনায় যথেষ্ট নিরীক্ষার অভাবে। কয়েকজন বিলেতফেরত আইনজীবী যদিও মূল কাজটা করেছিলেন, কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যান্য রাজনৈতিক সদস্যরা সাংবিধানিক রাষ্ট্র কাঠামো বিনির্মাণে যথেষ্ট প্রজ্ঞা দেখিয়েছিলেন কিনা, তা বর্তমান সময়ের নিরিখে সহজেই অনুমান করা যায়।

সংবিধান প্রণয়নকালে সংবিধানের বা রাষ্ট্রের চরিত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁরা যতটা এনার্জি ক্ষয় করেছিলেন, তার অর্ধেকও বোধহয় রাষ্ট্রের তিন (আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ) বিভাগের ক্ষমতার সমন্বয় বা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয়নি!

অতিমাত্রার নির্বাহী ক্ষমতা, গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনিশ্চয়তা, রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যে অসঙ্গতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব ও কিছু রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে চিরস্থায়ী রূপ দেওয়ায় এই সংবিধান সময়ের সঙ্গে চলতে অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে সার্বিকভাবে। তাই, একটা নতুন সংবিধান প্রণয়ন এই মুহূর্তে জরুরি।

রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিভাজিত হবার ক্ষেত্রে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার অনতিবিলম্বে প্রয়োজন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এ দেশে কখনও হয়নি। যেটা হয়েছে, তা হলো কেন্দ্রের ক্ষমতাকে বা সিদ্ধান্তকে স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা মাত্র। এ দেশের জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ, স্থানীয় সরকারের সব টায়ারগুলোকে, আমাদের পরাক্রমশালী এককেন্দ্রিক সরকারের অনুগত হয়ে চলতে বাধ্য করেছে। এর কারণে, কেন্দ্রগুলো সার্বিক ক্ষমতার চর্চা করে, আর অঞ্চলগুলো সেগুলো কোনোমতে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়। যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠন করা যায়, তাহলে শক্তিশালী প্রাদেশিক সরকার তৈরি হবে ও সেখানে স্থানীয় নতুন নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হবে। তখন কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার সমন্বয় দেখা যাবে। রাজনৈতিক ময়দানেও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর এক ধরনের সুষম প্রতিযোগিতা সম্ভব হবে।

এক্ষেত্রে সচেতনভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে গুটিকয়েক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ব্যতিরেকে, বাকি সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের কাছে ন্যস্ত করতে হবে।

সাংবিধানিকভাবে এটা নিশ্চিত করা দরকার যেকোনও রাজনৈতিক নেতা একবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধান হতে পারবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে যারাই একাধিকবার ক্ষমতায় আসে, তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা ও স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। তাই পাঁচ বা ছয় বছরের এক টার্মের বেশি ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিয়ে স্বৈরাচার তৈরির পথ খোলা রাখার মানে হয় না। বারবার প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগ থাকলে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চারও অভাব দেখা যায় এবং পারিবারিক সদস্য বা উত্তরাধিকারদের মধ্যে ক্ষমতা ঘুরপাক খেতে থাকে।

বর্তমানের সংসদীয় রাষ্ট্রকাঠামোয় রাষ্ট্রপতির কোনও কার্যকর ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতার দৈন্যতা, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে সীমাহীন ও চূড়ান্ত করেছে। ক্ষমতার এই বৈষম্য কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু ক্ষমতা ন্যস্ত করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপ্রধান যেহেতু খানিকটা অরাজনৈতিক অবস্থান নেয়, তাই কিছু সাংবিধানিক নিয়োগে যেমন উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ, নির্বাচন কমিশন নিয়োগে তার কার্যকর ও স্বাধীন ভূমিকা থাকা উচিত।

এমন ব্যবস্থাকে সেমি প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম বলে, যা ফ্রান্স, জার্মানিসহ অনেক ইউরোপিয়ান দেশে খুব সফলতার সঙ্গে কাজ করে।

আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার ক্যাবিনেটের আসলে তেমন কোনও জবাবদিহি নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে আসলে, সংসদও সরকারের ক্যাবিনেটকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করতে পারে না। তাদের অনাস্থা ভোট কার্যকর হয় না, কারণ বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না। এক্ষেত্রে ফ্লোরক্রসিং ল’ এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কোনও দল থেকে কেউ এমপি নির্বাচিত হলে, সে সেই দলের কোনও সিদ্ধান্তের বিপরীতে কোনও ভোট দিতে পারে না। এমন আইন গণতান্ত্রিক চর্চাকে সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত করে। তাই, নতুন সংবিধানে ফ্লোর-ক্রসিং ল’ সম্পূর্ণভাবে তুলে না দিলেও, এর ব্যবহারের ক্ষেত্রকে সীমিত করা উচিত। পাশাপাশি, ক্যাবিনেটকে জবাবদিহি করার জন্য একটা অ্যাডমিনিসট্রেটিভ কাউন্সিল করা প্রয়োজন, যেটা অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে। এটা একটা কুয়াসি-জুডিশিয়াল বডি হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করবে।

যেহেতু আমাদের দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ, তাই বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানো দরকার। সুপ্রিম কোর্টের কনস্টিটিউশনাল রিভিউয়ের ক্ষমতা বাতিল করে, এর এখতিয়ার শুধু দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি ও আপিল শুনানির জন্য রাখা উচিত। এক্ষেত্রে নতুন সাংবিধানিক কোর্ট স্থাপন জরুরি, যা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গঠিত হবে এবং তার বিচারিক কার্যক্রম চালাবে। এমন কোর্ট ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, আজারবাইজান, বেলজিয়াম, বেনিন, মিয়ানমার, মিসর, গ্যাবন, বেলারুশ, ইতালি, সিঙ্গাপুর, পোল্যান্ডসহ অনেক দেশে চালু আছে।

বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য মহাবিপদের কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করা ও অনুগত নির্বাচন কমিশন দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা। এই বিষয় থেকে উত্তরণ পেতে একটা অন্তর্বর্তী ও জাতীয় সরকার গঠন করা দরকার, যেন নির্বাচন স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হয়। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে ও যোগ্য ব্যক্তি দ্বারা সংসদ ও সরকার গঠনের জন্য, জার্মানির মতো জাতীয় নির্বাচনে প্রত্যেক ভোটারের জন্য দুটো করে ভোট রাখা যেতে পারে। যেখানে, একটা ব্যালটে ভোট দেওয়া হবে স্থানীয় প্রার্থীকে, যিনি ব্যক্তিযোগ্যতায় বা পরিচয়ে শুধু নির্বাচিত হবে। দ্বিতীয় ব্যালটের মাধ্যমে ভোটার নির্বাচনে পলিটিক্যাল পার্টিকে ভোট দেবে। এর মাধ্যমে দল ও যোগ্য প্রার্থী, উভয়েরই নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকবে।

লেখক : অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সৌজন্য : বাংলা ট্রিবিউন