অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পাঁচটি বিষয়ে নজর দিতে হবে
মীর আব্দুল আলীম
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সবার আগে পাঁচটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। এক. দ্রুত আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করা। দুই. অর্থনীতি চাঙ্গা করা। তিন. ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ করা। চার. দলীয় একক ক্ষমতা রোধ করা অর্থাৎ সব দল থেকে দুর্নীতিমুক্ত সৎ মানুষকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনা। পাঁচ. ভেজালমুক্ত খাবার নিশ্চিত করা।
শেষেরটা দিয়েই শুরু করছি। ভেজাল আর বিষাক্ত খাবার খেয়ে পচে যাচ্ছে দেশের মানুষের দেহ। মানুষ মরছে রোগে। মানুষ মরলে কাদের নিয়ে রাজনীতি করবেন আপনারা। তাই ভেজাল রোধ করতে হবে সবার আগে। এই কাজটা করা খুব সহজ। সদিচ্ছা থাকলে এখনই তা শুরু করা সম্ভব। সৎ কর্মঠ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সেই সঙ্গে ছাত্রদের যুক্ত করে জেলাভিত্তিক ভেজাল নির্মূল কমিটি করে এখনই কাজ শুরু করা যায়। যেখানে খাদ্যে ভেজাল মিলবে সেখানেই গ্রেপ্তার জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করা সময়ের দাবি। দেশের মানুষ নিরাপদ নেই। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুটতরাজ অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত এমন হয়নি বোধ করি। দুর্নীতিবাজ হাসিনা সরকারের সময় যেভাবে চাঁদাবাজি হয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সব কিছুর দাম যেভাবে বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তুলেছিল সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। কোথাও হাত বদল হয়েছে কোথাও আবার আওয়ামী লীগদের ওইসব নিয়ন্ত্রকরা সবাইকে ম্যানেজ করে তাদের রামরাজত্ব বহাল রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা উন্নতি করা এই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এটা বহু বছর ধরেই চলছে। রোধ করা যায়নি ব্যাংকদুর্নীতি। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি হয়েছে। দেশে বালিশকাহিনি বেশ আলোচিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এমন খবর প্রায়ই আমাদের পত্রিকাগুলো ছাপছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি হয়েছে। হলমার্ক দুর্নীতির কথা সবার জানা। হলমার্ক নামক একটি গ্রুপের টাকা মারার যেসব কাহিনি বেরিয়ে এল তা কি কখনো কল্পনীয় ছিল? সোনালী ব্যাংকের শুধু রূপসী বাংলা শাখা থেকেই তারা হাতিয়ে নিয়েছে ২৬৬৮ (দুই হাজার ছয় শ আটষট্টি) কোটি টাকা অর্থাৎ ২.৬৭ বিলিয়ন। আর সোনালী ব্যাংকের ওই একই শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে গায়েব হয়ে গেছে ৩৬০৭ (তিন হাজার ছয় শ সাত) কোটি টাকা অর্থাৎ ৩.৬০ বিলিয়ন। ব্যাংক দেয় আর ওরা নেয়। চোরে চোরে যেন মাস্তুত ভাই। এটা সোনালী ব্যাংকের জন্য যেমন একটা বিগ শ্যাম, মহাজোট সরকারের জন্য তা তো মহাপ্রলয়ও ছিল বটে।
ভেবে কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাই না, খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টে উপার্জিত ব্যাংকে রাখা জামানতের এত বিপুল পরিমাণ টাকা ঠকবাজরা দিনে-দুপুরে কীভাবে হাতিয়ে নিতে পারল। এর পরও এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান ব্যাংক গ্রাহকদের আমানতের টাকা নানা ফন্দিতে হাতিয়ে আখের গুঠিয়েছেন। এদের অনেকেই এখন ইউরোপ, আমেরিকার বাসিন্দা। ওদের টিকিটি ছোঁয় কে? আর ওরা বেজায় ক্ষমতাধরও। এর পরও কি বলব দুর্নীতিতে আক্রান্ত এ দেশে ক্যানসার হয়নি?
আসলে ক্যানসারেরও রকমফের আছে। আমাদের দেশটা এখন নানাবিধ ক্যানসারে আক্রান্ত। এর মধ্যে দুর্নীতি নামক ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দেশ এখন সিসিইউতে রয়েছে। ক্রনিক স্টিজে আছে এ দেশের ক্যানসার। রোগ সারবে না; মরবে দেশ কেবল আল্লাহই দেশটা রক্ষা করতে পারেন। আমাদের যে পরিমাণ অধঃপতন হয়েছে, আর আমাদের যা অবস্থা তাতে তিনি আমাদের দিকে শেষতক ফিরে তাকাবেন বলে মনে হয় না। দিন যত যাচ্ছে দেশের দুর্নীতিনামক ক্যানসার ততই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ।
এ তো গেল দেশের ক্যানসারের কথা। এ দেশের মানুষের দেহের ভেতরও তো অরিজিনাল ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। প্রতিনিয়তই তো আমরা বিষ খাচ্ছি। আমে, জামে, মাছে, ভাতে কোথায় নেই বিষ? প্রতিটি খাবারেই এখন বিষ মেশানো হচ্ছে। কদিন আগে এক বিখ্যাত কলামিস্ট তার লেখায় লিখেছিলেন- ‘আমরা প্রতি জনে; প্রতি ক্ষনে; জেনে-শুনে করেছি বিষ পান।’ প্রতি দিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি তাতে কোনো এক মাত্রায় বিষ মেশানো আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ বিষই আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিচ্ছে। কেবল হাসপাতালগুলোতে গেলেই বোঝা যায় কত প্রকার রোগই না এখন মানবদেহে ভর করে আছে। আসলে আমরা জেনে-শুনেই বিষ খাচ্ছি। না খেয়ে উপায়ই বা কি? তবে উপায় একটা আছে। না খেয়ে থাকলে এ থেকে হয়তো নিস্তার মিলবে; কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। তাই আমে, জামে, মাছে, সবজিতে বিষ মেশানো আছে জেনেও তা কিনে নিচ্ছি। আর সেই বিষ মেশানো খাবারই স্বপরিবারে গিলে চলেছি দিন-রাত।
ভেজাল আমাদের জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তেল, মসলা, লবণ, মুড়ি, চিনি, মাছ, দুধ, ফলমূল, সবজি, গুঁড়াদুধ, কেশতেল, কসমেটিকস সর্বত্রই ভেজাল। ফলের জুস, কোমল পানীয় এসবের বেশির ভাগই কৃত্রিম কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফল প্রথমে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়, পরে ফরমালিন দিয়ে প্রিজারভ করা হয়। দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাবারের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য বিরিয়ানি, জিলাপি, জুস, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারে সস্তা দামের টেক্সটাইল গ্রেড বিষাক্ত রং ব্যবহার করে থাকে, যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। খাবারে কৃত্রিম রং এবং জুসে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ ক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এমনকি আমাদের জীবন রক্ষাকারী ওষুধও ভেজাল থেকে শতভাগ মুক্ত নয়। খেতে ফলানো চালে, ডালেও ভেজাল। ক্রোমিয়াম নামক বিষ পাওয়া যাচ্ছে ওসবে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং ইথোফেন ব্যবহার করে আম, কলা, পেঁপে, আনারস, বেদানা, ডালিম, আপেলসহ এমন কোনো ফল নেই যা পাকানো না হয়। আবার ১০০/২০০ মি. গ্রা. বোতলজাত প্রভিট (ইথোফেন) বাজারজাত করা হয় যা সবজির সজীবতা রক্ষা করে। এই প্রকারের কেমিক্যালটি ব্যবহার করে তরিতরকারিকে দীর্ঘস্থায়ী করা হয়- যা বাজারের সবজির মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শুধু ফলমূল, মাছ আর সবজিতেই নয়- মিষ্টির দোকান থেকে শুরু করে মুদিদোকানের নিত্যপণ্য আর মনোহারী প্রসাধনীর এমন কোনো বস্তু নেই যাতে কেমিক্যালের সংশ্রব নেই।
মাংসও ভেজালমুক্ত নয়। অধিকাংশই খামারের গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ও খাবার সোডা। এতে গরু দ্রুত মোটাতাজা হলেও এর মাংস মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এসব গরুর মাংস খেলে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলেও মানুষের লিভার ও কিডনি ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সচেতন মহলের অভিযোগ, দেশে ল্যাব পরীক্ষা করার সুযোগ থাকলেও শিশুখাদ্যের অন্যতম উপাদান দুধে ফরমালিন মেশানোর বিষয়টিতে এখনো গুরুত্ব দেয়নি বিএসটিআই। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন আমলে না নেওয়ায় নগরীর ছোট-বড় অধিকাংশই দুগ্ধজাত প্রতিষ্ঠানে অবাধে ভেজাল ও বিষাক্ত উপাদানযুক্ত দুধ, চাল, আটা, ডাল, মাছ ও ফলমূলসহ নানা বিষাক্ত খাদ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো বছর রমজানের সময় মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ভেজাল এবং নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বিক্রেতা ও উৎপাদনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বিষাক্ত খাদ্যের ছোবল থেকে দেশ বাঁচাতে এখনো সময়োপযোগী কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। শুধু বাজারই বিষ মেশানো খাদ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে না। নামিদামি হোটেল, চায়নিজ রেস্টুরেন্ট, রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকানদাররা এ ধরনের খাদ্য দেদার বিক্রি করছে। আর আমরাও জেনেশুনে প্রতিনিয়ত বিষ খেয়ে চলেছি।
যত অনৈতিকই হোক, যতই বিষাক্ত হোক, মানুষ বেঁচে থাকুক আর মরুক তাতে যায় আসে না এ দেশের মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কাছে। তা তাদের কোনো বিবেচনার বিষয়ও নয়। মাছ, ফল, সবজি, দুধ, সব কিছুতেই ফরমালিন মিশিয়ে দীর্ঘদিন টাটকাভাব রাখার জন্য যে কৌশল তা সত্যিই খুবই অনৈতিক। মাছ তাজা রাখার জন্য সাধারণত বরফ দেওয়া হয়ে থাকে। এটা বহুকাল ধরে চলে আসছে। বরফ দেওয়া কোনো অপরাধের বিষয় নয়। যেহেতু বরফের চেয়ে ফরমালিনের দাম কম; অল্পতেই কাফি! তাই বরফের বদলে ফরমালিন দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফরমালিনের কার্যকারিতা বেশি বলে বরফেও কয়েক ফোঁটা ফরমালিন মিশিয়ে দেওয়া হয় এখন। তাতে ভেজালটা ধরার ক্ষমতা নেই। ভাবা কি যায় নৈতিকতার মান কোথায় নেমেছে! আজকাল নাকি কিছু ঠকবাজ ব্যবসায়ী ফরমালিন মেশানো মাছের ওপর কিছু গুড়, চিনিজাতীয় খাবার ফেলে রাখে। তাতে মাছে মাছি এসে বসে। এসব দেখে ক্রেতা ভাবে মাছ ফরমালিন মুক্ত। এভাবে ক্রেতাদের ধোঁকা দেওয়ার কৌশলও তারা আবিষ্কার করছে। ছি! কী সর্বনাশের কথা! জাতি হিসেবে আমরা কত নিচে নেমে গেছি।
কেমিক্যাল একটি সংরক্ষিত ক্ষতিকর পদার্থ। যা সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে অতি সাবধানতায় বিশেষ বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয়; কিন্তু অধুনা সর্বত্র এর যথেচ্ছ ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে এটা লবণের মতো অতি সস্তা, সহজলভ্য এবং ব্যবহারযোগ্য। আর এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত ভেজাল খাবার খাচ্ছি আমরা। রোগবালাইও হচ্ছে। শরীরে ক্যানসারের মতো কঠিন ব্যাধি বাসা বাঁধছে। ফরমালিনসহ খাবারে ব্যবহৃত ক্ষতিকারক কেমিক্যাল বিভিন্ন কাজে লাগে। ক্ষেত্র বিশেষ এটা দরকারিও। তাই আমদানি একেবারে নিষিদ্ধ করার উপায় নেই। তবে আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমদানিকারক ও ক্রেতাদের ওপর নজরদারি রাখতে হবে। ফরমালিন বা অনুরূপ রাসায়নিক দ্রব্যে বিক্রয় ও ব্যবহারে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।
দেশের উন্নয়নে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার যেমন বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে জরুরি দেশের জনগণকে ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করা। আমরা রোগে-শোকে আক্রান্ত দেশ চাই না। চাই সুস্থ-সবল সোনার দেশ। চাই সুস্থ মানুষ। এ জন্য আমাদের সততা, নিষ্ঠা ও জবাবদিহিতার কোনো বিকল্প নেই। আমরা সে দিনের প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।