রাতভর উত্যপ্ত বরিশাল নগরী
ববি ও বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাতভর হামলা পাল্টা হামলা
আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : মঙ্গলবার দিবাগত রাত এগারোটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত চরম কয়েক দফায় হামলা ও পাল্টা হামলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিলো নগরীতে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ ছাত্র লাঠিসোটা হাতে নানা শ্লোগান দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করে হামলা চালায় সরকারি বরিশাল বজ্রমোহন (বিএম) কলেজে।
এসময় বিএম কলেজের তিনটি বাস ও কলেজ ক্যাম্পাস ভাঙচুর করা হয়। হামলায় আহত হয়েছে উভয় কলেজের শতাধিক ছাত্র। গুরুত্বর আহতদের শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তথ্যের সত্যতা নিশ্চিম করেছেন কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান।
জানা গেছে, এর আগে ওইদিন নগরীর বটতলা এলাকায় বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের হামলায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এরমধ্যে গুরুত্বর আহত ১৫ জনকে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা নগরীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে ববি’র শিক্ষার্থীদের মারধরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাস ভাঙচুর করেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ববি’র শত শত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসযোগে নগরীতে এসে লাঠিসোটা নিয়ে মধ্যরাতে বিএম কলেজে পাল্টা হামলা চালায়।
শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, নগরীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোডের বাসিন্দা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনুভা চৌধুরী জোয়ার পরিবারের সাথে জমি নিয়ে পার্শ্ববর্তী পরিবারের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। গত ২ সেপ্টেম্বর বিএম কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী বিরোধ নিরসনের জন্য ঘটনাস্থলে আসে। কিন্তু ওই শিক্ষার্থীদের সাথে জোয়াদের কথাকাটাকাটি হলে বিষয়টি ববি শিক্ষার্থী জোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তার বন্ধুদের জানায়। পরে তারা সেখানে গেলে জানতে পারে জোয়া ও তার মাকে হেনস্তা ও অপমান করা হয়েছে। এরপর বিএম কলেজ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় জোয়ার বন্ধুরা। পরে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে চলে আসে। পরে হামলা ও হেনস্তার অভিযোগ এনে মঙ্গলবার বিকেলে পাল্টাপাল্টি মানববন্ধন করে ববি ও বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা।
সূত্রে আরও জানা গেছে, ওই ঘটনার জেরধরে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে নগরীর বটতলা এলাকায় ববি’র দুই শিক্ষার্থীকে পেয়ে মারধর করে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা। তখন প্রাণ বাঁচাতে ওই দুইজন ছাত্র দৌঁড়ে পাশ্ববর্তী বটতলা পুলিশ ফাঁড়িতে আশ্রয় নেয়। সহপাঠীদের মারধরের খবর পেয়ে রাত ১১ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০/৫০ জন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে করে ঘটনাস্থলে আসলে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা সেই বাসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এতে বাসের চালকসহ ১৫/২০ জন ছাত্র আহত হয়। পরে সহপাঠীদের মারধর করার খবর পৌঁছলে বাস ও ট্রাক বোঝাই হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নগরীর বটতলা ও তার পাশ্ববর্তী এলাকার এসে জড়ো হয়। অপরদিকে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাস ও তার আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়। এসময় বিভিন্নস্থানে উভয়পক্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
পরে রাত একটা থেকে পৌনে তিনটা পর্যন্ত বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে ববি শিক্ষার্থীরা হামলা চালায়। হামলার প্রথম পর্যায়ে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা পাল্টা হামলা চালানোর চেষ্টা করলেও সংখ্যায় অনেক কম হওয়ায় খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদেরসহ সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাদের দাবি, বিএম কলেজের এক শিক্ষার্থী যে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত তিনি বিরোধীয় জমি দখলের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তার পরিবারকে হেনস্তা করেছে। তার প্রতিবাদ জানাতে আসলেই ববি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা জানায়, বিরোধ সমাধানের চেষ্টা চালাতে গিয়ে বিএম কলেজের বৈষম্যবিরোধ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমান রাফিসহ কলেজের শিক্ষার্থীরা হামলার শিকার হয়েছেন। এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে রাতে ববি শিক্ষার্থীরা শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর নয়, প্রশাসনিক ভবন, আবাসিক হল ও বেশ কিছু বাস ভাঙচুর করেছে। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও ববি ছাত্রদের নিভৃত করতে তারা ব্যর্থ হন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রাত তিনটার দিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষার্থী বিএম কলেজের ভেতরে আটকা পরার খবর পাওয়া যায়। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে ভোর সাড়ে চারটার দিকে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
বিএম কলেজের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিন পর্যন্ত কলেজে এসে এক বিধবা নারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের খুঁজে কান্নাকাটি করে জানায়, তার নির্মানাধীন ভবনের কাজ প্রায় চার বছর ধরে বন্ধ করে দিয়েছে এক প্রতিবেশী। ওই বিধবা নারীর অনুরোধে বিএম কলেজের একটি টিম গত ২ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল নগরীর ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোড এলাকায় গিয়ে বিধবার প্রতিবেশীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। বিষয়টি ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তার বন্ধুদের ডেকে এনে এ অস্থিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. উন্মেষ রায় জানান, হামলায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন ৩৩ জনের মত ভর্তি রয়েছেন। বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, হামলায় তাদের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ সাইফুল ইসলাম জানান, সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিএম কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল হক জানান, তিনটি বাস, প্রশাসনিক ভবন, হোস্টেল ও কলেজের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়েছে। কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, সেনা সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এসময় পুলিশ সদস্যরা তাদের (সেনাসদস্য) সঙ্গে ছিলেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও আর্থিক পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহসিন উদ্দীন জানান, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিএম কলেজে ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে। এ সংক্রান্তে একটি লিখিত মুচলেকাও হয়েছে।
ববি’র সকল ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ
বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের ক্লাস ও পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনিবার্য কারণবশত বৃহস্পতিবার সকল বিভাগের ক্লাস ও পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। তবে অফিসসহ অন্যান্য কার্যক্রম যথারীতি চলমান থাকবে।
সূত্রমতে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় ববি’র প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। আহতদের শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ অবস্থায় বরিশাল নগরজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
(টিবি/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২৪)