রহিম আব্দুর রহিম


আমার মামারা চার ভাই, বড় মামা মরহুম আতাব আলী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ছোটজন প্রয়াত মাহতাবউদ্দিন প্রান্তিক ব্যবসায়ী, আব্দুল হক মামা ছিলেন তরুন ফুটবলার, সবার ছোট মামা আব্দুস সামাদ তাঁদের সংসারী কাজের সহযোগী। নানা ফয়েজ উদ্দিন সরকার  ওরফে ফতু সরকার। তিনি ও তাঁর পরিবারের লোকজনরা ১৯৪৭ সালে দিকে ভারত বিভক্তকালে তৎকালীন দিনাজপুরের  এই অঞ্চলের (পঁচাগড়) ছোবারভিটা (প্রেত্তানীরহাট) গ্রামে বসতি গড়েন। নানাদের পৈত্রিক নিবাস টাঙ্গাইল জেলার বর্তমান ধনবাড়ি উপজেলার কাউয়ামারা গ্রামে। পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রী। এই অঞ্চলে এসে পেশা পরিবর্তন করে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত হন। 

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বড়মামা আতাব আলী অংশ নেন। সবে মাত্র দেশ স্বাধীন। ভিলেজ পলেটিক্সের শিকার এই মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন ফেরারী ছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতেই তিনি জামালপুরের দিগপাইত, তারারভিটা, সরিষাবাড়ির করগ্রাম, ধনবাড়ির কাউয়ামারা, মধুপুরের মনতলায় অবস্থান করেছেন। ওই সময়ে মামার মুখে পঞ্চগড়ের প্রকৃতি, সৌন্দর্যের বর্ণনায় মুগ্ধ হতাম। বিশেষ করে মহারাজ এবং কাজলদিঘীর নানাকাহিনী শোনে। সেই থেকেই পঞ্চগড় আসা-যাওয়া। যতবারই এসেছি,ততবারই মহারাজদিঘী, কাজলদিঘী দেখতে গিয়েছি। সবুজ শ্যামলিমায় ভরা দিঘীর চারপাশের বৃক্ষরাজী, ডালে ডালে পাখ-পাখালীর কিঁচির-মিঁচির শব্দে মুখরিত হতো গোটা এলাকা। সন্ধা নামলে ঝিঁ-ঝিঁ শব্দে ঝিঁঝিঁ পোকার অনিন্দ প্রকৃতিতে স্বর্গ নেমে আসতো। শেয়ালের হুক্কাহুয়ার মাঝে চিতাবাঘের হরদম আনাগোনা। ঠিক ওই সময়ের পঞ্চগড়ের চৌদ্দগোসাই, ভাগ্যধর, লীলা-পাগলীসহ অসংখ্য কাহিনীর নির্ভর পালাগানে বিভোর ছিলো সংস্কৃতিপ্রেমী লাখো মানুষ।

পরিবেশিত হতো রংপাঁচালী, মানপাঁচালী। পূজা -পার্বণকে কেন্দ্র করেই হতো আয়োজন। হ্যারিক্যান, হ্যাজাকবাতির আলোতে বসতো আসর। যে পালার নেই কোন স্ক্রীপ্ট। না আছে পরিচালক। গ্রাম বাংলার মানুষের আচার-আচরণ, স্বভাব চরিত্র, দুঃখ কষ্টের নানা কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত পালায় অভিনয় করতো অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত গ্রামের খেঁটে খাওয়া মানুষ-জনরা। পুরুষরাই সাজতো নারী। সে কি অভিনয়! কখনও হাসি-কান্না, আবার কখনও বীরত্ব। আশ্বিন -কার্তিক মাসের দিকে বিশেষ করে হিন্দুদের দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, বিশ্বহরি (মনসা) কিংবা দোলপূর্ণিমা ঘিরেই জমে উঠতো খোলা আঙ্গিনা। যে কারণে শীত আসলেই মামার বাড়ি চলে আসতাম। শোনতাম, দেখতাম এই সমস্ত পালা।এক সময় যা নেশা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৬-১৯৮৭ সালের দিকে পরিচয় ঘটে তৎকালীন কণ্ঠশিল্পী এবং পঞ্চগড়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মুকুটবিহীন সম্রাট প্রহল্লাদ চন্দ্র বর্ম্মণের সাথে। গানে-অভিনয়ে সমান পারদর্শী এই ব্যক্তির সাথে নানা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয় বহুবার।

ঐ সময়কার জনপ্রিয় গণসঙ্গীত, 'রিকশাওয়ালা কারো শালা কারো আবার দুলাভাই...।' এই গানটি সংগ্রহ করে প্রহল্লাদ দাকে দিয়েছি। পরবর্তীতে এইগানেই অঞ্চলখ্যাত শিল্পী হিসেবে পরিচিত লাভ করেন তিনি। যাই হোক, মামার বাড়ি আসা-যাওয়ায় পঞ্চগড়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত হয়ে উঠি।যেখানেই অনুষ্ঠান সেখানেই উপস্থাপক হিসেবে আমন্ত্রণ পাই। ছোট থেকেই অভিনয় করি। আমার অভিনীত কৌতুকপ্লট 'পুতুলনাচ' ও 'সরলারবাপ' ধামের গানে পরিবেশিত হতো। তৎকালেই পঁচাগড়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষদের সাথে বন্ধন। বিকাল হলে পঞ্চগড়ের গ্রাম-গঞ্জের খেলার মাঠে জমজমাট হয়ে উঠতো। পাশের দেশ ভারতের শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর থেকে খেলোয়াড়েরা আসতো ফুটবল খেলতে। ক্রীড়া, সাংস্কৃতির প্রতি অনুরাগই আমাকে পঞ্চগড়ে টেনেছে। এখন পঞ্চগড় আমার, আমি পঞ্চগড়ের।

প্রথম আসা মার সাথে। সন, তারিখ মনে নেই। তবে একেবারে ছোট বেলায় ১৯৭৬-৭৭এর দিকে। তখন এখানকার কৃষি ফসলের মধ্যে চিনা-কাউন, গোলআলু, মিষ্টি আলু, সবজির মধ্যে কচুরমোড়া। বেশী সম্পত্তির মালিকরা চাষ করতেন ভূট্টা এবং গম। পোশাক- আশাকে নারীরা খন্ডিত শাড়ি, পুরুষরা নেটিং লুঙ্গি, কিংবা ধুতি পড়তেন। ধনী, দরিদ্র নেই, প্রায় সবার বাড়িতেই ছিলো সাইকেল। সকালের নাস্তা চাউল ভাঁজার সাথে গুড়ের তৈরি গরম চায়ের মিশ্রণ। বিকালে হাট বাজারে উঠে আসতো গাঁ-গেরামের মানুষজন। ছোট ছোট চায়ের স্টলে বাঁশের মাচায় বসে চা পান। ফাঁক-ফোঁকরে মতি বা পাতার বিড়ির শুকটান। নানা অভাবে নিমজ্জ্বিত এই অঞ্চলের জন-মানুষরা ছিলেন প্রচন্ড অতিথি-পরায়ন, এখনও যা বিদ্যমান। আমার উপস্থাপনায় তখনকার দিনের অন্যতম জনপ্রিয় তরুন কণ্ঠশিল্পী ছিলো নকুল চন্দ্র বিশ্বাস, ওর গান 'আইসা মাসের বাইসা তারিখ, ঠিক হইছে মোর বিয়ের তারিখ' হাজারো দর্শককে মাতিয়ে তুলতো।

যে কথা বলছিলাম, পঞ্চগড়ের সমৃদ্ধ লোকজপালা পেঁচকাটার সংসার একবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আমন্ত্রণে জাতীয় নাট্যশালায় শো করার সুযোগ পায়। এছাড়া রাষ্ট্রীয় কোন সুযোগ বা আমন্ত্রণ তারা পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। এবার নববর্ষ-১৪৩২ বঙ্গাব্দ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত তিনদিনব্যাপী বৈশাখী লোক নাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত গ্রাম লাঠুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। উৎসবের শেষদিন পরিবেশিত হয় ফকির সমে আলী সম্প্রদায়ের সত্যপীরের গান ‘বাহরাম বাদশা’। গীতি এবং নৃত্যনাট্যের সংমিশ্রণের পালার কাহিনী 'দানশীল এক বাদশার দান খয়রত করার এক আজব কাহিনী, বাদশা বাহরাম প্রতিদিন সকল থেকে দুপুর অবধি তাঁর রাজ্যের দরিদ্র, ভিখারিদের দান করেন,যে যা চান তাকে তাই দেওয়া হয়।এক দুপুরে সত্যপীর এসে বাদশা বাহরামের কাছে স্বর্ণ-অলংকার ভিক্ষা চাইলেন, কিন্তু তখন বেলা অপরাহৃ। এখন সম্ভব না। এছাড়া স্বর্ণ অলংকারও শেষ হয়েছে। তাই তিনি সত্যপীরকে পরেরদিন সকালে দান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন এবং সত্যপীরকে তার রাজমহলে রাত্রিযাপনের আমন্ত্রন জানান। এবার সত্যপীর, বাদশাহকে পরীক্ষার জন্য, তবে তিনটি শর্তে দিয়ে বলেন, আমি রাত্রিযাপন করতে যদি আপনি আমাকে আপনার 'ঈমান' দান করতে হবে,না হয় সমস্ত 'স্বর্ণমুদ্রা', তা না হলে 'রাজসিংহাসন'। রাজা বেকায়দায়, সকল স্বর্ণাদির ভান্ডার অনেক আগেই শেষ। ঈমান দেওয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়; কি করার? দান করে দেন 'রাজসিংহাসন।'এবার বাহরাম বাদশার নিজেই ফকির।'

উৎসবের দ্বিতীয় দিনের পরিবেশনা ছিলো আটোয়ারির হরিগুরু সম্প্রদায়ের ধামেরগান 'বাবার শেষ বিয়ে।' পালার কাহিনী, '২ সন্তানের এক জনকের স্ত্রী মারা গেলেন। বৃদ্ধ বাবার বড় ছেলের বউ শ্বশুরকে ঠিকঠাক দেখভাল করা তো দূরের কথা, প্রয়োজনীয় খাবার দাবারও দেয় না। এমন অবস্থায় বৃদ্ধ বাবা সিদ্ধান্ত নেন, সে বিবাহ করবে।কিন্তু তার দুই সন্তান এবং সন্তানের বউ তাকে বিয়ে দিতে রাজী নয়।কারণ ওয়ারিশ বাড়বে। নাছোড়বান্দা বাবা বিয়ে সে করবেই; কারণ দুঃসময়ে তার দেখভালের প্রয়োজন রয়েছে। নারাজী সন্তানদ্বয়কে নানা কৌশলে রাজী করাতে না পেরে এক প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নেই বৃদ্ধ বাবা। তবে ভাগ্যে কোন যুবতী মেয়ে জুটলো না। জুটলো এক বৃদ্ধা। এরপর আরও যা ঘটলো.. ।'

এই দিনের পালায় দর্শকরা প্রাণ উজাড় করে হাসতে পেরেছে। উৎসবের উদ্বোধনী দিনে ২৩ এপ্রিল পরিবেশিত হয়েছে, দেবীগঞ্জের তৃপ্তি নাট্যগোষ্ঠীর হুলিরগান পেঁচক্যাটার সংসার, পালার কাহিনীও মজাদার, 'স্বামী-স্ত্রীর সংসার ভালই চলছিল, নেই তাদের সন্তানাদি, অভাবি সংসারের স্বামী ঢাকায় কাম কাজ করে আয় রোজগার করবে বলে তার স্ত্রীকে জানাল। যেই কথা, সেই কাজ। সিদ্বান্ত হলো ঢাকায় যাবার, কিন্তু তার স্ত্রী সঙ্গে যাবার বায়না ধরলো, কিন্তু তাকে নিতে রাজী নয় স্বামী পেঁচকাটার। কারণ, তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। গ্রাম্য এক বাজারের মুড়ি কেনাবেঁচা করতো এক সুন্দরী- সুশ্রী যুবতী। তার রূপ-চেহারায় আকৃষ্ট পেঁচক্যাটার ঐ নারীর টানে ঢাকায় যাবার কথা বলে বাড়ি ছাড়ে। পরে মুড়ি বিক্রেতার সাথে মন দেওয়া নেওয়া। প্রেমের উসিলায় বিয়ে, এরপর বাড়ি ফেরা। একেতো অভাব, তারপর দুই বউয়ের সংসার, পেঁচক্যাটা নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লো, বউ থাকতে বিয়ে, সংসারের জ্বালা যন্ত্রনার নানা ঘটনা এই পালায় উঠে এসেছে।'

বৈশাখী লোকনাট্য উৎসবের সার্বিক সহযোগিতা করে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন। উদ্বোধন করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এস.এম.ইমাম রাজী টুলু। প্রতিদিন দেখা হয়েছে নতুন নতুন বিনোদন প্রেমিব্যক্তিদের সাথে। প্রতিদিন দেখেছি পঞ্চগড় জেলা কালচারাল অফিসার সৈয়দ জাকির, জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ আক্তারুজ্জামান এবং দিশারা নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার মোঃ রফিকুল ইসলাম সরকারকে। দিনব্যাপী উৎসবের প্রতিটি পালায় হাজার দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিই প্রমাণ করেছে, পঞ্চগড়ের লোকজ পালার কদর, চাহিদা সেই আগের মতই আছে।

লেখক : নাট্যকার ও গবেষক।