কৃষক মরছে মাঠে, ফড়িয়া হাসছে হাটে!
মীর আব্দুর আলীম
গ্রামের কৃষক যখন তার ঘাম-ঝরা পরিশ্রমে উৎপাদিত সবজি বা ধান বাজারে নিয়ে যান। তখন তার আশা থাকে-ন্যায্য দাম পাবেন, সংসারের খরচ চালাবেন, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ দেবেন। ভোক্তাও চান ন্যায্য মূল্যে ভালো মানের পণ্য কিনতে। বাস্তবতা হলো, কৃষক যখন লাভের মুখ দেখবে উৎপদিত পণ্য হাটে নিয়ে যান, তখন তাঁকে বাধ্য করা হয় ফড়িয়াদের নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে। অনেক সময় জোর করে, আবার কখনো হুমকি দিয়ে তার কাছ থেকে পণ্য কেঁড়ে নেয়া হয় কম দামে। অথচ সেই পণ্যই শহরে এসে বিক্রি হয় তিনগুণ, কখনো চারগুণ বেশি দামে।
দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো কৃষি। সেই কৃষির হৃদয়ে আঘাত হানছে একটি ভয়ংকর দুর্বৃত্ত চক্র-যাদের আমরা বলি ফড়িয়া। এই তথাকথিত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি এখন শক্তিশালী সিন্ডিকেটে রূপ নিয়েছে। উৎপাদকের ক্ষেত থেকে ভোক্তার বাজারে যেতে যেতে পণ্যের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। কৃষক ন্যায্য দাম পান না, আর ভোক্তা চড়া দামে নি:শেষ হয়। লাভবান একমাত্র ফড়িয়া। তারা যেন বাজার ব্যবস্থার অদৃশ্য দানব। বছরের পর বছর ধরে উৎপাদক ও ভোক্তার মাঝখানে গজিয়ে উঠা এই অদৃশ্য কার্টেল বা সিন্ডিকেট এখনো অব্যাহতভাবে দেশজ পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। তারা ঠিক ক্যান্সারের মতো-আস্তে আস্তে কৃষক, ভোক্তা এবং রাষ্ট্রের সার্বিক অর্থনীতিকে গিলে ফেলছে। এই ব্যবস্থায় কৃষকের লাভ তো হয়ই না, উল্টো কৃষিকাজে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। তরুণরা কৃষি ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে, কৃষিজমি পরিণত হচ্ছে আবাসিকে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন বাজারে গিয়ে দেখছে নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁইছুঁই। টমেটো, সজীব করলা, কিংবা চালের বস্তা-সবই যেন এখন মধ্যবিত্তের জন্য বিলাসিতার নামান্তর।
এদেশে নিত্যপণ্যের দামের ওঠানামা ফড়িয়াদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে। তারা কখনো কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, কখনো মজুত করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে। আর এই সিন্ডিকেটের ছায়াতলে রয়েছে কিছু রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাও। ফলে প্রশাসনও অনেক সময় চুপ থাকে, অনেক সময় নিরুপায়। প্রশ্ন আসে-এই ফড়িয়ারা এত বেপরোয়া হলো কীভাবে? উত্তর হলো-তারা একা নয়। তাদের পেছনে রয়েছে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, এমনকি কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তাও। তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে গড়ে উঠেছে এই জটিল সিন্ডিকেট, যারা শুধু বাজার নয়-রাষ্ট্রের নীতিও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সরকারি নজরদারি এড়িয়ে চলে তাদের কারসাজি। অভিযান চালানো হলেও তা হয় লোক দেখানো, বা আগে থেকেই ‘বার্তা পাঠানো’ থাকে-“সাবধান, কাল অভিযান।”
এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে কার্যকর রোডম্যাপ দরকার। কেবল হঠাৎ করে অভিযান চালিয়ে হবে না। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা, আইনি কাঠামো এবং রাজনৈতিক শুদ্ধতা। নিচে কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো:
১. কৃষিপণ্য সরাসরি বিপণন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ: সরকারি ও আধা-সরকারি ক্রয় কেন্দ্র চালু করে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য কিনতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় স্থায়ী বা ভ্রাম্যমাণ ক্রয়কেন্দ্র চালু করে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘বিটাক’, ‘টিসিবি (Trading Corporation of Bangladesh)’, ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তর’ কিংবা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে একটি কার্যকর রোডম্যাপ প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
এই কেন্দ্রগুলো মৌসুমি চাষের সময় সীমিত না রেখে সারা বছর চালু রাখা গেলে, কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য নিশ্চিত বাজারে বিক্রি করতে পারবে, তাও ন্যায্য দামে। বিশেষ করে সবজি, ফল, দুধ, ডিম, মাছ ও ধান/চাল-এ ধরনের দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্যের জন্য শীতলীকৃত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ (cold storage logistics) ও দ্রুত পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জেলা-উপজেলা ভিত্তিক সংরক্ষণাগার, হিমাগার এবং চেইন পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে এই কৃষিপণ্যকে শহরাঞ্চলে নিয়ে যেতে পারলে ভোক্তা ন্যায্য দামে পণ্য পাবে, কৃষকও লাভবান হবে।
২. ডিজিটাল কৃষি হাট ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন: সরকার চাইলে প্রতিটি উপজেলায় ডিজিটাল কৃষি হাট চালু করতে পারে। এতে কৃষক নিজের মোবাইল ফোনে ঢুকেই জানতে পারবে কোন পণ্যের দাম কেমন, কোথায় বিক্রি করতে গেলে ভালো দাম পাওয়া যাবে। এতে ফড়িয়াদের দাপট কমবে।
৩. সিন্ডিকেট শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনা: ফড়িয়া-ভিত্তিক সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে শুধু বাজার অভিযান যথেষ্ট নয়-প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা। নিজেদের মধ্যে থাকা সুবিধাভোগী দালালদের রক্ষা না করে বরং দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। অনেক সময় রাজনৈতিক পরিচয়ে প্রশাসনও নির্বিকার থাকে। এই চক্রের অর্থের উৎস ও লেনদেনের পথ অনুসন্ধানে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (FIU) ও দুদককে কার্যকরভাবে যুক্ত করতে হবে। হঠাৎ সম্পদশালী হয়ে যাওয়া দালালদের আয় ও সম্পদ যাচাই করে, প্রয়োজনে ঘইজ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহায়তায় শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এই সিন্ডিকেট শুধু বাজার নয়, দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনকে জিম্মি করে রেখেছে। তাই এর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ক্ষমতা বৃদ্ধি: বর্তমানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জরিমানা করে এবং সেই অভিযানের ছবি প্রকাশ করে সামাজিক সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করে থাকে। তবে এই কার্যক্রম অনেক সময়ই ক্ষণস্থায়ী এবং প্রতীকী রূপে থেকে যায়। ফলে ভোক্তার অধিকার বাস্তবিক অর্থে সুরক্ষিত হয় না। এই প্রতিষ্ঠান যেন কেবল তাৎক্ষণিক জরিমানা করে চলে না যায়, বরং একটি নিয়মিত ও টেকসই বাজার তদারকির জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং মানবসম্পদ কাঠামোর অধিকার ও সংস্থান লাভ করে-এটাই এখন সময়ের দাবি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করার ক্ষমতা দিতে হবে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় নির্ধারিত সংখ্যক দক্ষ জনবল নিয়োগ, মোবাইল ল্যাবরেটরি, গাড়ি ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জামের ব্যবস্থা থাকতে হবে যেন তারা খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদির মান তদারকি করতে পারে।
বর্তমান আইনে জরিমানার সীমা তুলনামূলকভাবে কম এবং এর ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা অনেক সময়ই জরিমানা দিয়ে আবার একই অপরাধে লিপ্ত হয়। তাই আইন সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা আরও কঠোর করতে হবে—যেমন, পুনরাবৃত্ত অপরাধে ব্যবসায়িক লাইসেন্স বাতিল, কারাদণ্ড, এবং বৃহৎ অর্থদণ্ড নিশ্চিত করা যেতে পারে। অধিদপ্তরকে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী রেগুলেটরি বডিতে রূপান্তর করার চিন্তা করা যেতে পারে, যেন তারা রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে। এই সংস্থার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি আলাদা “ভোক্তা অভিযোগ সেল”, হটলাইন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা যেতে পারে, যেখানে সাধারণ জনগণ সহজেই অভিযোগ জানাতে পারবেন এবং তার প্রতিক্রিয়া পাবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—ব্যবসায়ী, ভোক্তা এবং সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে একটি কার্যকর সংলাপ ও সমন্বয়ের পরিবেশ তৈরি করা। তবেই ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় এই প্রতিষ্ঠানটি কেবল “জরিমানা ও ছবি” তোলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না থেকে, বাস্তবিক অর্থে বাজারে শৃঙ্খলা ও ন্যায্যতার প্রতীক হয়ে উঠতে পারবে। ৫. সচেতনতা ও মিডিয়া ভূমিকা: সাধারণ জনগণের ভোক্তা অধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেলিভিশন, সংবাদপত্র, রেডিও, অনলাইন নিউজ পোর্টালসহ সকল প্রচারমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
শুধু তাৎক্ষণিক খবর প্রচার নয়, বরং নিয়মিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থার অসঙ্গতি, মজুতদার ও ফড়িয়াদের কারসাজি, মূল্যবৃদ্ধির কৃত্রিম সংকট ইত্যাদি জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে। এতে জনগণ যেমন সচেতন হবে, তেমনি প্রশাসনও চাপ অনুভব করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। সোশ্যাল মিডিয়ারও বড় ভূমিকা রয়েছে। সচেতন নাগরিকদের উচিৎ হবে বাজারে যে কোনো অনিয়ম বা প্রতারণার ঘটনা ঘটলে সেটি ছবি বা ভিডিওসহ সামাজিক মাধ্যমে তুলে ধরা, যার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং প্রশাসন তৎপর হয়। তবে এর জন্য মিডিয়া লিটারেসি বাড়াতে হবে, যাতে গুজব নয় বরং সত্য তথ্যই ছড়ায়। এছাড়াও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভোক্তা অধিকার বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজনের জন্য মিডিয়া হস্তক্ষেপ করতে পারে। মিডিয়া হাউজগুলো নিজস্ব সামাজিক দায়িত্ববোধের অংশ হিসেবে এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে গণমাধ্যমে ‘ভোক্তা অধিকার সপ্তাহ’, ‘ন্যায্য বাজার ক্যাম্পেইন’, ‘প্রতিদিনের বাজারদর বিশ্লেষণ’ ইত্যাদি চালু করা যেতে পারে।
পরিশেষে একটাই কথা-কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, আর ভোক্তা বাঁচবে সিন্ডিকেট ভাঙলে। রাষ্ট্র যদি চায়, তবে এই মধ্যস্বত্বভোগী চক্রকে ভাঙা সম্ভব। প্রয়োজন কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এবং প্রশাসনিক অঙ্গীকার। আমরা যদি সবাই সচেতন হই-ভোক্তা, কৃষক, প্রশাসন, গণমাধ্যম-তাহলে এই চক্র ভাঙা সময়ের ব্যাপার। এখনই সময়, কৃষকের ঘামে সেচিত মাঠ আর শহরের বাজারে থাকা ভোক্তার মুখে একসঙ্গে হাসি ফোটানোর। রাষ্ট্র এটা করে দেখাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: চেয়ারম্যান-আল-রাফি হাসপাতাল লিমিটেড, সাংবাদিক, জীবনমুখী লেখক, কলামিস্ট।