ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শনিবার (৩ মে) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫। সংবাদপত্রের সম্পাদনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও সংবাদকর্মীদের মেধা, মনন ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে প্রতিদিনই প্রকাশিত হয় একটি সংবাদপত্র। সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ। জ্ঞানের ভান্ডার। আবার বলা হয় সভ্যতার অগ্রদূত ও সৃজনশীল প্রতিভাধর সমাজের সম্মানিত ব্যাক্তি।বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ দিবসটি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ইউনেস্কো দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির জানান দেয় আগে থেকেই।

গুরুত্বকে নিশ্চিত করার এবং সাংবাদিকতা জোরদার করার জন্য ব্যবহার সামগ্রীর উৎপাদন, বিতরণ এবং সংবর্ধনা প্রভৃতি বিষয়ে অনুসন্ধান করার আহ্বান হিসাবে কাজ করা এবং কাউকে পিছনে না রেখে স্বচ্ছতা ও ক্ষমতায়নের অগ্রগতি করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশেষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করে। এসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটি পেরিয়ে যায়। দিবসটি প্রতিবছর আসে-যায়।

প্রতিবছর ৩ মে বিশ্বজুড়ে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করা হয়। বাংলাদেশেও সাংবাদিক সংগঠন ও বিভিন্ন সংস্থা এ উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। একটি সংবাদপত্রে দেশ ও জাতির সকল বিষয়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সংবাদপত্র প্রকাশের স্বাধীনতা যতটুকু রয়েছে। ততটুকুতেই দেশের নাগরিকদের মতামত প্রকাশে সুযোগও রয়েছে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শগুলো চিহ্নিত করে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত আফ্রিকার নামিবিয়ায় উইন্ডোহয়েক শহরে ইউনেস্কো ও ইউএনডিপিআই এর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ডিক্লারেশন অব উইন্ডোহয়েক ঘোষণা করা হয়।

১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘৩ মে বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। সংবাদপত্রই প্রথম সৃষ্টি করেছে সভ্যতার উন্নয়নের উত্তাল ঢেউ। বাংলাদেশ বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির দেশ হিসেবে এগিয়ে চলছে। ধীরে ধীরে এর ধাপ আরো বৃদ্ধি পাবে। শিল্প, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তির নীতি গ্রহণ করা হয়। সংবাদপত্র শিল্পেও এটি চলে আসছে। বৈশ্বয়িক করোনা কালেও সংবাদত্র ও সাংবাদিক বন্ধুগণ থেমে নেই। দেশের প্রিন্টিং, ইলেকট্রনিস্কস ও অনলাইন মিডিয়াগুলো বিরামহীন গতিতে তাদের সংবাদ দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরছে।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে দৃষ্টিপাত করা যাক আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছে। এ দিবসটির প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো প্রতি বছরের মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার একটি বৈশ্বিকসূচকও প্রকাশ করে থাকে।

আমাদের দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৯৬২ সালে কলা অনুষদে ডিপ্লোমা- ইন-জার্নালিজম নামে একটি কোর্স চালু হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এ কোর্সটি বন্ধ করে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৮০ দশকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৯০ দশকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি কোর্স চালু করা হয়। বলা যায় – যার হাওয়ায় আমাদের দেশে সংবাদপত্রের বিকাশ লাভ করে আসছে।

২০০০ সালের আগে দেশের সংবাদপত্রগুলো মুদ্রণশিল্পের মাধ্যেমে প্রকাশিত। শিসা বা তামা কিংবা লোহার ধাতব পদার্থের মাধ্যমে বাংলা ভাষা প্রতিটি বর্ণ বসিয়ে বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে সংবাদপত্র ছাপানো হতো। যা ছিল ধৈর্য ও কায়িক শ্রমের বহিঃপ্রকাশ।

বর্তমানে এর পরিবর্তে স্বল্প সময়ে,কম্পিউটার কম্পোজে, পেস্টিং করে দ্রুততম সময়ে অটোমেটিক বৈদ্যুৎতিক ছাপাখানার মাধ্যেমে বর্তমানে সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে খুব অল্প সময়ে দেশের যে কোনো স্থান থেকে ই-মেইল করে সংবাদ প্রেরণ একটি মাইলফলক উম্মুক্ত হয়। শুধু তাই নয়- ভিডিওতে দৃশ্য ধারণ করেও সংবাদ প্রাণবন্ত করে তোলা হচ্ছে পাঠকের কাছে। এর কারিগর হলো আমাদের সাংবাদিকবন্ধুগণ।

সাংবাদিকরন্ধুগণ দিনের পর দিন অবাধ তথ্য প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার জ্ঞান অর্জন করে সংবাদপত্র অতি আধুনিক পদ্ধতিতে বের করতে সহায়তা করছে। যার ফলে যে কোনো সংবাদ, বিষয়, ছবি ও সংশ্লিষ্ট পেক্ষাপটগুলো খুবই চমৎকার ও শিল্প নৈপুণ্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে।তাইগণমাধ্যমকে বলা হয় একটি সমাজের দর্পণ। আমাদের চারপাশের নানান ঘটনার মধ্যে জরুরি এবং ব্যতিক্রম যা সাধারণের জানার আগ্রহ আছে, জানার প্রয়োজন আছে তা গণমাধ্যমে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। একটি সংবাদ একজনের প্রয়োজন মেটায়, একটি সমাজের অসংগতি দূর করে, ইতিহাস ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ মানুষের জানার ক্ষুধা মেটায় সংবাদ। আর সেটা যে মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাই গণমাধ্যম। সংবাদের সংজ্ঞায় জন বোগার্ট বলেছিলেন- কুকুর মানুষকে কামড়ালে সংবাদ হয় না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে তা সংবাদ হয়।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তান আমলে আমাদের গণমাধ্যম ছিল হাতেগোনা। কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না বলে সাংবাদিকদের অনেক কৌশলে সংবাদ পরিবেশন করতে হয়েছে এদেশের মানুষের জন্য। এর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুক্ত হয়েছে অসাংবাদিক প্লাটফর্মে।গণমাধ্যমের এই বিকাশের সুযোগে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এবং অসাংবাদিক চলে আসে সাংবাদিকতার পেশায়। তারা লেজুড়বৃত্তিক সাংবাদিকতা শুরু করে স্বার্থান্বেষী মহল ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। ফলে সাংবাদিকতার মান ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আজ যে কেউ এসেই একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হচ্ছেন। অথচ সাংবাদিকতায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পাদক হওয়ার বিধান নেই। কিন্তু হচ্ছেন। এ কারণে যে কেউ সাংবাদিকতাকে বিকৃত করে সংবাদ পরিবেশন করছেন। নিজস্ব স্বার্থে সংবাদকে প্রভাবিত করছেন। ভুল সাংবাদিকতা দিয়ে সমাজে উসকানি দিচ্ছেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন পাস হওয়া ‘নিউজ পেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স’ নামে আইনটি করা হয়েছিল তখনকার সাংবাদিক নেতাদের পরামর্শে। এর আগে পর্যন্ত সাংবাদিকদের কোনো বেতন কাঠামো ছিল না। মালিকরা সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন দিতেন না।

এই লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের অবশ্য-কর্তব্য এবং সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য পরাকৌশল। কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে নাগরিকগণ চরিত্রনিষ্ঠ হয়, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ও সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পায়।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মানুষকে নৈতিক জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ যেন সে অনুসরণ করে চলে। তার যেন সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদণ্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য থাকে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি-পর্যায়ে কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা খুব দরকার।

এজন্য বিদ্যমান আইনকানুন, নিয়মনীতির সঙ্গে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। সেই অঙ্গীকারকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমের সক্রিয় প্রচেষ্টা গুরুত্ববহ। আর বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থাহীনতার পেছনে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষাপট রয়েছে। গত দুই দশকে সাংবাদিকতার নামে রাজনৈতিক চাটুকারিতা, সুবিধাবাদী আচরণ এবং গণমাধ্যমের অংশবিশেষের পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ভূমিকা সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিকে বিপন্ন করেছে। প্লট, ফ্ল্যাট কিংবা আরও কিছু ব্যক্তিগত প্রাপ্তির লোভে সাংবাদিকতার নীতি বিসর্জন দেওয়ার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের কাছে সাংবাদিকতার গ্রহণযোগ্যতাকে দুর্বল করেছে।

তবে এ বাস্তবতা যেন বর্তমান সরকার বা অন্য কোনো পক্ষকে পুরো গণমাধ্যমকেই দোষারোপ করার সুযোগ না দেয়। কিছু ব্যতিক্রমী আচরণের জন্য পুরো পেশাটিকে কলুষিত করা একেবারেই অন্যায়। বরং সাংবাদিকদের হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং তাঁদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

গণমাধ্যমকে চাপ দিয়ে কিংবা হয়রানির মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতা বন্ধ করার যে চেষ্টা, তা সাময়িকভাবে হয়তো কারও স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটি রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল আইনের চোখে নয়, বাস্তব চর্চায়ও নিশ্চিত হওয়া জরুরি। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার সঠিক তদন্ত এবং প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি হয়রানির শিকার না হন। একইভাবে, অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের মতো পদক্ষেপের জন্যও একটি স্বচ্ছ এবং ন্যায্য প্রক্রিয়া চালু করা প্রয়োজন।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনই সাংবাদিকদেরও নিজেদের পেশাগত নৈতিকতা এবং দায়িত্বের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। অতীতে সাংবাদিকতার নামে চাটুকারিতা কিংবা পক্ষপাতিত্বের যে উদাহরণ দেখা গেছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে একটি স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম গড়ে তুলতে হলে সব পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে।

চ্যালেঞ্জ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে তথ্যপ্রবাহের জগতে চটুলতা, রুচিহীনতা বা সস্তা কাজ একটা বড় জায়গা করে নিয়েছে। প্রকৃত সাংবাদিকদের কাজ হলো চটুলতা পরিহার করে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। মানুষ যতই সামাজিক মাধ্যমে গা ভাসিয়ে দিতে চেষ্টা করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা সত্যের সন্ধান করবেই। গণমাধ্যম সেই সঠিক তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সঠিক তথ্যপ্রবাহ এবং সঠিক তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। এখানে আসে সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতার বিষয়টি। সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা হচ্ছে সমাজের প্রতি এবং জীবনের প্রতি।

গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা, সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা এবং সাংবাদিকতার সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠছে। দেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকের সংখ্যাও বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এই সাংবাদিকরা পেশাগত মান এবং সমাজের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন।
সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব

গণমাধ্যম ও সমাজের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে সমাজকে আশ্রয় করে। গণমাধ্যম সর্বপ্রথম মানুষের তথ্যের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করেছে। এটা মানুষের কৌতূহল নিবৃত্ত করেছে এবং করে যাচ্ছে। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমেরও বিকাশ ঘটেছে। চরিত্র এবং চেহারাগত পরিবর্তন এসেছে গণমাধ্যম জগতে ব্যাপকভাবে। একেক যুগে মানুষ একেক ধরনের মূল্যবোধ লালন করেছে এবং গণমাধ্যম সমাজকল্যাণের উদ্দেশে সেসব মূল্যবোধের প্রসার ঘটিয়েছে।

সমাজের প্রতি গণমাধ্যমের যে দায় এবং যে দায়িত্ববোধ, সেটা সত্যিকারার্থে প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছে। সমাজ এবং সামাজিক ব্যবস্থাকে সঠিক পথে এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সব সময় অসামান্য অবদান রেখেছে। বিচ্যুতিও আছে। থাকাই স্বাভাবিক। তবে সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের ভূমিকা সব সময় প্রশংসনীয়।

বিশ্বব্যাপী প্রেস ফ্রিডমের অবস্থাইউনেস্কোর রিপোর্ট বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫৫ জন সাংবাদিককে তাঁদের কাজের কারণে খুন হতে হয়েছে ৷ ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সর্বাধিক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটেছে মেক্সিকোতে৷ তার পরেই আছে আফগানিস্তান ও সিরিয়ান আরব রিপাবলিক৷ ২০২৪ সালে বিশ্বের ১৮টি দেশে অন্তত ১২৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে ১০২ জন এবং ২০২২ সালে ৬৯ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছিল। ২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৫২ নম্বরে। সাংবাদিকতার জন্য যে দেশগুলিকে 'খারাপ'-এর তালিকায় ফেলা হয়, তার মধ্যে রয়েছে আমাদের দেশ৷ ব্রাজিল, রাশিয়া ও মেক্সিকোর মতো দেশগুলিও এই তালিকায় রয়েছে৷ ১৮০ দেশের তালিকায় সবার উপরে রয়েছে নরওয়ে৷ তারপরে আছে ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও ডেনমার্কের নাম৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে নেপাল ১০৭, শ্রীলঙ্কা ১২৭ ও মায়ানমার ১৪০ নম্বরে রয়েছে৷ অর্থাৎ এই তিন প্রতিবেশী দেশের ব়্যাঙ্কিং বাংলাদেশ থেকে ভালো৷ পাকিস্তান রয়েছে ১৪২ ও ১৪২ নম্বরে রয়েছে ভারত।আর গত বছর ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর গত প্রায় ৭ মাসে গাজায় ১৪১ জন সাংবাদিক নিহত ও ৭০ জন আহত হয়েছেন।আর গত পাঁচ বছরে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ শতাংশই তাঁদের দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সাক্ষী৷ আজকের দিনে স্বাধীন ভাবে কাজ করার মৌলিক অধিকারের দাবিতে সরব আপামর সাংবাদিকবৃন্দ ৷

পরিশেষে বলতে, গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার প্রত্যাশিত ভূমিকার কারণে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা ‘গণতন্ত্র, বৈষম্যহীন সমাজ, আইনের শাসন ও সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এগিয়ে নিতে হলে গণমাধ্যম সংস্কারের এখনই সময়।

শিকড় থেকে বিকশিত সংস্কৃতি ও দায়িত্বশীল অধিকারবোধসম্পন্ন সমাজ গঠনে নাগরিক ও গণমাধ্যমের মধ্যে আদান-প্রদান প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তাদের সঠিক তথ্য দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি এবং সেটি ধরে রাখতে পারাই গণমাধ্যমের অন্যতম দায়িত্ব। সেটি অর্জন করতে অবশ্যই গণমাধ্যকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী হতে হবে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রতি অনুগত সুবিধাভোগী ও অসাধু চক্রের কবজায় চলে গিয়ে অধিকাংশ গণমাধ্যম অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। এ ছাড়া গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের বেশকিছু আইন, নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা ও অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যায় মুক্ত গণমাধ্যমের পথ চলা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

সমাজের অতন্দ্র প্রহরী সাংবাদিক। অসংগতি, অনিয়ম, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সব ঘটনা-দুর্ঘটনা বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহভাবে জনগণকে অবহিত করাই গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা, কালো টাকা, মাফিয়া চক্র এবং অপসাংবাদিকতার কারণে গণমাধ্যম ছিটকে পড়েছে এ দর্শন থেকে। পাশাপাশি এই দর্শনে বিশ্বাসী সাংবাদিকদের ভূমিকা, সুরক্ষাও সংকুচিত। কারণ, সাংবাদিকদের মূল শক্তি তাদের ইউনিয়নও এখন রাজনৈতিক লাইনে বিভক্ত। গণমাধ্যমকে তার মূল দর্শনে ফেরাতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।আর আমরা সবাই জানি, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর প্রসারে সাংবাদিকতার পরিধি আজ ব্যাপক ও বিস্ময়করভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে অনেকে এও বলে থাকেন, এই সম্প্রসারণ ঘটেছে কেবলই বহিরাঙ্গে, অন্তরে বা আত্মায় নয়। হয়তো সে কারণে সাংবাদিকতার ‘কমিটমেন্ট’ নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে। মানতেই হবে স্পিড, কালার, কনটেন্ট ইত্যাদির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে গণমাধ্যমের। টিভির অনুষ্ঠান ‘লাইভ’ বা সরাসরি হচ্ছে। মোবাইল ফোন কিংবা আইপ্যাডের স্ক্রিনে সবকিছুই এখন হাতের নাগালে। বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে সব দেশের সংবাদপত্র এখন নিমিষে পাঠ করা যায়।

সব ভাষার, সব চরিত্রের, সব সংবাদপত্র এখন আন্তর্জাতিক; গণমাধ্যম আজ কেবল দেশীয় বা আঞ্চলিক নয়, থাকারও সুযোগ নেই। সে কারণে অনেকে ভয় পান ‘অনলাইনের’ এই যুগে প্রিন্ট বা ছাপা কাগজের সংবাদপত্র কোথায় নাকি হারিয়ে যায়! হারিয়েছেও কিছু কিছু। কিন্তু প্রিন্টের যে স্বাদগন্ধ আছে তাকে অস্বীকার করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, প্রিন্ট থাকবে এবং নিজের মর্যাদাতেই থাকবে; যেমনি ইলেকট্রনিক পুস্তকের ব্যাপক প্রসারের পরেও বই ছুঁয়ে দেখার আনন্দ কমেনি আজো। তবে বলতেই হবে, অধুনা সাংবাদিকতার বেশকিছু সংকট বা সীমাবদ্ধতা আছে, যা হরহামেশাই লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন, সাংবাদিকতা যতটা শরীরের রূপে বেড়েছে ততটা অন্তরে বা ‘কমিটমেন্টে’ বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা ‘অ্যাডভারটাইজমেন্ট’ এবং ‘প্রোপাগান্ডা’ হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যই মুখ্য হয়েছে। এসব অভিযোগ যদি আমলে নেই, না নেয়ারও সঙ্গত কারণও নেই, তাহলে বর্তমান সাংবাদিকতার কতিপয় বড় প্রতিবন্ধক নিশ্চয়ই চিহ্নিত করা উচিত হবে।এখন দেখবার চেষ্টা করি কী কী প্রতিপক্ষ বা প্রতিবন্ধকতা আছে অধুনা সাংবাদিকতার। কারণ এই চিহ্নিতকরণ যদি করা যায় এবং সে লক্ষ্যে কাজ করা যায়, তাহলে সাংবাদিকতা গৌরবান্বিত হবে।

আমার বিশ্বাস, আগেকার দিনের মতো মুক্ত বা স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতিপক্ষ এখন কেবল স্বৈরাচারী সরকার বা রাষ্ট্রশক্তি নয়। পরিবেশ বা পরিস্থিতি বদলেছে। বিশ্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রভূত বদলেছে। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নানাবিধ চতুর আইনের প্রতিবন্ধকতা আছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার সহায়ক নয়। এর বাইরেও আরো বহুবিধ প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়েছে। যেমন ক. বড় পুঁজির আধিপত্য, খ. বাণিজ্যকরণের আধিপত্য, গ. অসহিষ্ণু দল ও স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠীর আধিপত্য, ঘ. ধর্মীয় উগ্রবাদের আধিপত্য, ঙ. সংবাদকর্মীদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক প্রভাব, চ. জনস্বার্থ বিবেচনা বা ‘কমিটমেন্টের’ ঘাটতি ইত্যাদি। এর পরেও আরো কিছু প্রতিবন্ধক নিশ্চয়ই আছে, যা সাংবাদিকতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। যেমন অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন, সংবাদকর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি।এর পরেও বলতে হবে যে, বর্তমান যুগে সাংবাদিকতার প্রভাব ও প্রসার বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে সংকটও। সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পেশা, এ পেশা মহত্ত্বের দাবিদার। তবে জানা এবং মানা দুটিই প্রয়োজন যে, এই পেশা সংবাদকর্মীদের জন্যে কেবলই চাকরি নয়, কিংবা সংবাদশিল্পের মালিকদের জন্য কেবলই ব্যবসা নয়। অনেক ক্ষেত্রে এর অন্যথা ঘটে বলে সাংবাদিকতা মর্যাদা হারায়।

আমার বিশ্বাস, সাংবাদিকতার মান আরো বাড়বে, যদি চিহ্নিত সংকটগুলো দূর করার চেষ্টা করা হয়। এসব সংকট বা প্রতিপক্ষ, যা এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে উল্লেখিত হলো, তা এক এক দেশ ও সমাজে একেক রকম হতে বাধ্য। আমি কেবল নিজের উপলব্ধিতে কথাগুলো উপস্থাপন করলাম। তাই আমাদের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হয় দিবসটিতে।

লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।