রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের খলিষাখালিতে ভূমিহীন কামরুল হত্যা মামলায় সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত সাতনদী পত্রিকার সম্পাদক বহুল আলোচিত হাবিবুর রহমানের জামিন আবেদন না’মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। মাহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে আজ বৃহস্পতিবার  তিনি সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে বিচারক এ আদেশ দেন।

জামিন না’মঞ্জুর হওয়া হাবিবুর রহমান আশাশুনি উপজেলার মহাজনপুর গ্রামের মৃত আব্দুল আজিজ মোড়লের ছেলে। বর্তমানে তিনি সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুরে বসবাস করেন।

সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার খলিষাখালিতে জমিদার চ-িচরণ ঘোষের ফেলে যাওয়া ১৩১৮ বিঘা লাওয়ারিশ সম্পত্তিতে বসবাসকারি ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে নিজেদের দখলস্বত্ব কায়েম করে সোনবাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে গত বছরের পহেলা নভেম্বর শুক্রবার সকালে সেখানে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান পরিচালনা করান কালিগঞ্জের নলতা ইউপি চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আরিজুল ইসলাম, তার ব্যবসায়িক অংশীদার আনারুল ইসলাম (মাছ), পারুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু ও সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা সিরাাজুল ইসলাম।

এ সময় সেনা অভিযান শেষ না হতেই ভূমিহীন নেতা কামরুল ইসলামকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পিটিয়ে জখম করা হয় ২০ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে। কামরুল হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম বাদি হয়ে সাংবাদিক হাবিবুর রহমানসহ ২৩ জনকে আসামী করে অজ্ঞাতনামা ৮০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এ মামলায় হাাবিবুর রহমান গত ১৬ মার্চ মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি আবু তাহের মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মোঃ শওকত আলী চৌধুরীর বেঞ্চ থেকে আট সপ্তারের অন্তবর্তীকালিন জামিন লাভ করেন। আদালতের নির্দেশে হাবিবুর রহমান বৃহস্পতিবার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে আইনজীবী সাতক্ষীরা জজ কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাড. আব্দুল মজিদ (২) এর মাধ্যমে জামিন আবেদন করলে বিচারক মোঃ নজরুল ইসলাম উভয়পক্ষের শুনানী শেষে তার জামিন না’মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। শুনানিকালে হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।

তবে শুনানিকালে হাবিবুর রহমান আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে ২০২২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করার জন্য পিপি অ্যাড. আব্দুল লতিফের পরামর্শে ২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট কলারোয়ায় শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা মামলায় বর্তমান পিপি অ্যাড. আব্দুস সাত্তার, বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৫০ জন আসামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছিলেন বলে উচ্চারিত হয়। একইভাবে সাংবাদিক ইয়ারব হোসেনও পিপি আব্দুল লতিফের পরামর্শে সদরের ঝাউডাঙা ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকে ইউপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপি নেতা হাবিবুল ইসলামসহ আসামীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দেন।

জামিন শুনানিকালে আদালতে উপস্থিত থাকা অ্যাড. জিয়াউর রহমান, সিরাজুল ইসলামসহ (৫) কয়েকজন আইনজীবী জানান, জামিন না’মঞ্জুর হওয়ার পর আসামী হাবিবুর রহমান বিচারকের কাছে নিরাপত্তা দাবী করেন। বিচারক রাষ্ট্রপক্ষের পিপিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেন। এর কিছুক্ষণ পর অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. কামরুজ্জামান ভুট্টো ও অ্যাড. ইমরান শাওননের সহায়তায় পুলিশ তাকে গারদখানায় নিয়ে যওয়া হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের পিপি অ্যাড. আব্দুস সাত্তার সাংবাদিকদের কাছে হাবিবুর রহমানের জামিন না’মঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

প্রসঙ্গত, জাল জালিয়াতের মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরী করে দেবহাটার শিমুলিয়ার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, সখিপুরের আব্দুল আজিজ ও একই এলাকার বেসরকারি সংস্থা আইডিয়ালের পরিচালক নজরুল ইসলাম, পারুলিয়ার ইকবাল মাসুদ সহ বেশ কয়েকজন ভূমিদস্যূ চ-িচরণ ঘোষের ফেলে যাওয়া এক হাজার ৩১৮ বিঘা সম্পত্তি দখল করে আসছিলো। ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওই জমি লাওয়ারিশ হিসাবে ঘোষনা করে। এরপর ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে সাপমারা খালের দুই ধার থেকে উচ্ছেদ হওয়া প্রায় ৮০০ পরিবার সেখানে বসবাস করে আসছিলো। প্রশাসন যাতে তাদের উচ্ছেদ না করতে পারে সেজন্য ভূমিহীনদের পক্ষ থেকে

মহামান্য হাইকোর্টে ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৫০০/২২ নং রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। বিভাগীয় কমিশনার, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়। আদালত ভূমিহীনদের বসবাসের সুবিধার্থে স্থিতাবস্থা জারি করে। যাহা আজও চলমান। স্থিতাবস্থা জারি থাকার পরও ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর তৎকালিন পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামানের সহায়তায় ভূমিদস্যুরা ভূমিহীনদের ৭৮৫টি বাড়িতে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এর আগে ভূমিদস্যূদের দায়েরকৃত মামলায় খালাস পাওয়া আসামী শরিফুল, কামরুল (শুক্রবার নিহত) ও মুর্শিদকে আদালত থেকে ধরে এনে ডাকাতির চেষ্টা ও অস্ত্র মামলায় কোর্টে পাঠায় পুলিশ। একই দিনে নোড়ার চকের ইউনুসকে বদরতলা মাসের সেট থেকে তুলে নিয়ে জেলেপাড়া মোড় থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠায় পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও নির্যাতনের খবর প্রকাশ করায় সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি শহরের পিএন হাইস্কুল এর পাশ থেকে তুলে নিয়ে তাকে গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালান তৎকালি পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান। এ আটক ও নির্যাতনের অন্যতম ভূমিকা রাখেন সাতনদী পত্রিকার সম্পাদক হাবিবুর রহমান। নিজে পত্রিকা সম্পাদক হওয়ায় তিনি কথিত জমির মালিক ও ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ইচ্ছমত সংবাদ প্রকাশ করতেন। এ সময় সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁর নামে একটি নাশকতা ও একটি চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে জমির মালিক দাবিদাররা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে সিভিল রিভিউ পিটিশন ১৬৮/২১ দাখিল করেন।২০২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ৫ সদেস্যর বিচারপতিদের বেঞ্চ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিচারকের বেঞ্চ ওই জমি লাওয়ারিশ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসককে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে খাস করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবসা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও গত ১৫ মাসে তা কার্যকর হয়নি।

নলতার চেয়ারম্যান আরিজুল ইসলাম, নলতার আনারুল ইসলাম(মাছ), পারুলিয়ার চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবু, সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, নওয়াপাড়ার সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল ইসলাম সহ একটি স্বার্থান্বেষী মহল আইনপ্রয়োগকারি সংস্থার সদস্যদের একাংশকে ম্যানেজ করে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করার জন্য দফায় দফায় হামলা চালিয়ে আসছিলো। ২০২৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ও ২৩ সেপ্টেম্বর তারা বোমা ও গুলি ছুঁড়ে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে। গুলিতে মনিরুল ও আল আমিন জখম হন। এ ছাড়া কমপক্ষে ৩০ জন ভূমিহীনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়। নোড়ার চকের আবুল হোসেনসহ কমপক্ষে ৩০ টি ভূমিহীনের বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় নলতা ইউপি চেয়ারম্যান আরিজুল ইসলামকে প্রধান আসামী করে তিনি(মর্জিনা) ও আবুল হোসেনের স্ত্রী থানায় একটি এজাহার দিলেও মামলা নেয়নি পুলিশ।

এই বিষয়ে ভূমিহীনরা গত বছরের ৩ অক্টোবর জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সেনা ক্যাম্পে স্মারকলিপি দেয়। এরপরও সেনাবাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে গত বছরের পহেলা নভেম্বর খলিষাখালিতে অভিযান পরিচালনা শেষে চেয়ারম্যান আরিজুল, গোলাম ফারুক বাবু, আইডিয়ালের নজরুল, সুরুজ কাজী, মাছ আনারুল ও ইকবাল মাসুদের নেতৃত্বে ভূমিহীনদের উপর হামলা চালানো হয়। হামলায় তার স্বামী ভূমিহীন নেতা কামরুল ইসলাম নিহত হন। কালিগঞ্জ উপজেলার বাবুরাবাদ গ্রামের আকরাম হোসেনের ছেলে রবিউল আউয়াল, একই গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে মহরম , আতিয়ার রহমানের স্ত্রী লায়লী খাতুন, সামছুরের স্ত্রী সফুরা খাতুন, আকরামের স্ত্রী তাসলিমা খাতুন, রাজিয়া খাতুন, ফরিদা খাতুন, পাইকাড়া গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে হাসিব, কাশিবাটি গ্রামের হাসিদুল হাসান সবুজ, আরিজুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ও আশাশুনির শ্রীকলস গ্রামের আবু সাঈদের ছেলে সোহেল রানাসহ কমপক্ষে ২০ জন নারী ও পুরুষ ভূমিহীন জখম হন। আহত ছয়জন ভূমিহীনকে হামলাকারিরা তাদের মজুত করা অস্ত্র দিয়ে প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়। আহত ছয়জনসহ নিহত কামরুলের নাম উল্লেখ করে পহেলা নভেম্বরের পরিবর্তে পহেলা অক্টোবর রামনাথপুর গ্রামের আব্দুল আলিম বাদি হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।

তবে কামরুল হত্যা মামলায় তিনজন আসামী জামিন পাওয়া ও হাবিবুর রহমান আদালতের নির্দেশে আদালতে হাজির হলেও আরিজুল ইসলামের ভাড়া করা অস্ত্রধারি ক্যাডার চিংড়িখালির শহীদুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম বুল্লা, তালার মাঝিয়াড়ার পাখরা হালিম, নোড়ারচকের আনারুল ইসলাম, তার শ্য্যালক রবিউল ইসলামসহ ১৯ জন এজাহারভুক্ত ১৯জন আসামী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না। এমনকি মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা পরিবর্তন চাইলেও পুলিশ সুপার বাদিকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে আরিজুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম ও গোলাম ফারুক বাবুর নেতৃত্বে কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলা বিএনপি’র ব্যানারে সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে পারুলিয়া বাসস্টা-ে মানববন্ধন করা হয়।

(আরকে/এসপি/মে ০৮, ২০২৫)