কানাইপুরে ইন্টারনেট কর্মীকে কোপানো রাজিবের গ্রেফতারে প্রতিবেশীদের স্বস্তি

রিয়াজুল রিয়াজ, ফরিদপুর : ফরিদপুরের কানাইপুরে ইন্টারনেট কর্মী আল আমিন খান (২১)কে কুপিয়ে জখম করা সন্ত্রাসী রাজিব মুন্সি (২৩)কে গ্রেফতারে এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর বরোটার দিকে সন্ত্রাসী রাজিব ও ইন্টারনেট কর্মী আল আমীনের বাড়ী ফরিদপুরের কানাইপুরের খাসকান্দি গ্রামে সরেজমিনে গেলে প্রায় শতাধিক লোক এসে ভীর করে রাজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তারা সবাই রাজিবের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিলেন বলে জানান গ্রামবাসী। এরা সবাই রাজিবের একই পাড়া প্রতিবেশী এবং উপস্থিত ওই প্রতিবেশীগণ প্রায় সবাই রাজিব কতৃক ভুক্তিভোগী। তারা রাজিবের অত্যাচারে সবাই প্রায় অতিষ্ঠ ছিলেন বলে জানান তারা।
এ সময় রাজিবের বাড়ীর পাশের প্রতিবেশি কসাই এর কাজ করা মো. ইউসুফ শেখ এর স্ত্রী হামিদা বোগম (৩৮) জানান, 'কিছুদিন আগে প্রকৃতির ঢাকে সারা দিয়ে বাইরের বাথরুমে আসলে রাজিব শুধু লুঙ্গি পড়া ও খালি গায়ে ঘরে ঢুকে মোবাইল খুঁজতে থাকে। আমি বাথরুম থেকে বের হলে রাজিব দৌড় দিয়ে পালাতে গিয়ে বাইরে কাপড় সোকানো জন্য টাঙানো তারে আটকে যায়, অন্ধকারে চিনতে কষ্ট হলে কাছে গিয়ে দেখি রাজিব। ওই অবস্থায় ও আমার থেকে আমার হাতের মোবাইলটি ছিনিয়ে নিতে এগিয়ে আসে। আমি চিৎকার দিলে রাজিব পালিয়ে যায়।'
এ সময় ওখানে উপস্থিত আরেক প্রতিবেশি গণি মাঝি'র স্ত্রী লিপি আক্তার (২৯) বলেন, 'গত মাসে আমার বেড রুমে ঢুকে বড় একটি রান দা নিয়ে। আমরা সবাই ঘুমে ছিলাম, রাজিব আমার মোবাইল নিয়ে ওই অস্ত্র ফেলে দৌড়ে চলে আসে।' এসময় প্রায় পাঁচ-সাত জন মোবাইল নিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলেন।
সোহেল মিয়া (৩৭) নামের এক এলাকাবাসী জানান, 'আমি একজন সৌখিন কবুতর খামারি ছিলাম। বিভিন্ন জাতের আটাশটি কবুতর সহ আমার কবুতর রাখার ঘর সহ রাজিব চুরি করে নিয়ে এসে আরেক প্রতিবেশির কাছে বিক্রি করে দেয়। এতে আমার প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। অনেক যায়গায় গিয়েছি বিচার চাইতে কিন্তু এই এলাকায় বিচারহীনতা এতোটাই বাজে যে, আমাকে মাত্র দুই হাজার টাকা দেওয়া হয় বিচারের মাধ্যমে। ' সোহেল আরো জানান, 'যে প্রতিবেশির কাছে আমার কবুতরের ঘরসহ কবুতর বিক্রি করেছে, তার কাছে শুধু ঘরটি ফেরত চেয়েছিলাম, সেটিও দেয়নি।' তারপর থেকে আমি কবুতর ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি।'
এ সময় এলাকাবাসী জোসনা বেগম (৩৫), রেহানা আক্তার (৬৫), মালেক মাঝি (৬৭), মো. দেলোয়ার হোসেন (৫০), চম্পা বেগম (৪৮) জানান, রাজিব এমন কোন কাজ নয় যে করতো না। আমাদের এখানে কোন বিচার নাই। রাজিব নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সারা রাত জেগে এলাকায় বাড়ীতে বাড়ীতে টহল দিতো, আর সুযোগ বুঝে হাস-মুরগি, মোবাইল, টাকা পয়সা এমনকি জামা কাপড় পর্যন্ত চুরি করতো। কেউ কিছু বললে, 'আমি ডিবির চাকরি করি, র্যাবের চাকরি করি, আমার বড় ভাইদের দিয়ে কোপাবো, ছোট ভাইদের দিয়ে কোপাবো, জানে মেরে ফেলবো' ইত্যাদি নানা রকম হুমকি দিতো।'
আল আমিনকে কোপানোর আগে কয়েকদিন যাবত এলাকার অনেককেই রাজিব বলে বেড়াচ্ছিলো, 'আমি কিন্তু একজনকে খাবো, জানে শেষ করে দিবো। কিন্তু সে কাকে কি করবে তার নাম বলতো না কে?' এলাকাবাসী আরো জানায়, 'আমরা ওর হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের এড়িয়ে চলতাম। তবুও ওকে কেউ কিছু বলার সাহস পেতাম না।' তারা প্রায় সবাই জানান, 'রাজিবের যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ ছিলাম। এখন সে গ্রেফতার, জেলে থাকায় কয়েকদিন যাবত একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারছি। তবে কতোদিন এভাবে থাকতে পারবো জানি না।'
সম্প্রতি গত ৩ মে রাত সাড়ে নয়টার দিকে স্থানীয় ইন্টারনেট কর্মী মো. আল আমিন খান (২১)কে কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদ রোডে থামিয়ে হাতে ও বুকের বাম সাইডে ছুরিকাঘাত করে মারাত্মক জখম করে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে আহত করে। এরপর তার সাথে থাকা ইন্টারনেট মাসিক বিল তোলা ৬০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে স্থানীয় এলাকাবাসী তাঁকে উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে।'
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আল আমীন খানের বাবা মুদি দোকানদার মো. খোকন খান (৫৭) ফরিদপুর কোতয়ালি থানায় একটি অভিযোগ করেন গত ৫ মে। যার মামলা নম্বর ১০, ধারা: ৩৪১, ৩২৩, ৩২৬, ৩০৭, ৩৭৯ ও ৫০৬ পেলাল কোডে রুজু করে থানা পুলিশ।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে ফরিদপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসাদ উজ্জামান জানান, 'ওই মামলার প্রধান আসামি রাজিব মুন্সীকে গ্রেফতার ইতিমধ্যে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।'
মামলার বাদি খোকন খান এজাহারে অজ্ঞাতনামা আরও ২/৩ জনকে আসামি করলেও পুলিশ রাজিব মুন্সী ছাড়া আর কারো সম্পৃক্ততা পায়নি। এ বিষয়ে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) ও ফরিদপুর কোতয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রবিউল ইসলাম জানান, 'আসামি রাজিব ছাড়া এই মামলায় আর কারো সম্পৃক্ততা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, রাজিবকে আদালতে তুললে আলাদত জেল হাজতে প্রেরণ করেছেন। মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে।'
এদিকে, মামলার বাদি খোকন খান জানান, 'ভাগ্য ভালো যে, এলাকাবাসী আমার ছেলেকে দ্রুত মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা না হলে বাঁচাতে পারতাম না। ওর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ রক্ত বের হইছে।' তাছাড়া, 'সন্ত্রাসী রাজিব আমার ছেলের বুকের বাম পাশে যেখানে ছুরিকাঘাত করেছে, আর একটু ডিপ হলেই ওর হৃদপিণ্ড ছিদ্র হয়ে যেতো। আল্লাহ নিজ হাতে আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছেন বলেও জানান খোকন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আল আমিন খান জানান, 'আমার রাজিবের সাথে তেমন কোন কিছুই ছিলো না, আমি নাকি বাপের দোকানের সামনে বসে মোবাইলে হিসেব চালাই, অফিসের কালেকশনের হিসেব নিকাশ করি, এতেই নাকি ওর সমস্যা। তাছাড়া রাজিব বলছে আমাকে খুন করবে, ও জামিনে বের হয়ে এসে যদি আমাকে সত্যিই খুন করে ফেলে, আমি সেই চিন্তাই করতেছি এখন।'
এদিকে, ভুক্তভোগীর প্রতিবেশি ও আসামি রাজিব মুন্সির অসুস্থ বাবা বাচ্চু মুন্সী বলেন, 'আমার একটা মাত্র ছেলে তাকেও আমি মানুষ করতে পারিনি। প্রতিদিন এতো নালিশ শুনি যে, আমার আর কিছুই ভালো লাগে না। আফসোস করে বাচ্চু বলেন, এখন আর ওকে নিয়ে ভালো কিছু আশা করি না। আমি মরে গেলেই বেঁচে যাই বাবা। যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না।'
(আরআর/এসপি/মে ০৮, ২০২৫)