দাবি শ্বশুরের
শাশুড়ির অত্যাচারে কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন পলাশের স্ত্রী
দিলীপ চন্দ, ফরিদপুর : দেশের বহুল আলোচিত র্যাব কর্মকর্তা পলাশ সাহার আত্মহতনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার স্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন করে একতরফাভাবে দেওয়া হয়েছে একের পর এক স্ট্যাটাস। কিন্তু ফরিদপুরে পলাশের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে জানা গেল ভিন্ন কথা।
ফরিদপুর শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন চৌধুরী পাড়ার বাসিন্দা ৬২ বছরের বয়সী ভরত সাহা। তার ২০ বছর বয়সী একমাত্র কন্যা সুস্মিতা সাহার দুই বছর আগে বিয়ে হয় পলাশের সাথে।
গত শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে চৌধুরীপাড়া গিয়ে দেখা যায়, ভরত সাহা ক্রমাগত বিলাপ করে চলেছেন মেয়ে জামাইয়ের জন্য। তিনি বলছেন, তার মেয়েকে অনেক ভালোবাসতো পলাশ, নিজের হাতে খাইয়ে দিত, সময় পেলে বেড়াতে নিয়ে যেত, যেটা সহ্য হতো না পলাশের মা‘র।
ক্রমাগত কাঁদতে কাঁদতে বেহুস হবার মত অবস্থা সুস্মিতা সাহার বাবা ভরত সাহার। তিনি বলছেন, ‘‘আমরা বড় লোকের সাথে মেয়ে দিতে চাইনি, ছেলে অনেক শখ করে আমার মেয়েটাকে এক রকম জোর করেই নিয়েছে। ছেলের আগ্রহ দেখেই আমরা শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে দিয়েছি, কিন্তু আমার মেয়ে তো শাশুড়ির অত্যাচারে স্বামীকে বাঁচাতে পারল না, মেয়েটা আমার কয়েকবার আত্মহত্যা করতে গেছে, এখন আমি ভয় পাচ্ছি মেয়েটা নিজেকে না শেষ করে দেয়। ওই দজ্জাল শাশুড়ি নিজেও মেয়েটাকে মেরে ফেলতে পারে।’’
ভরত সাহা বলেন, ‘‘উনি খুবই ভয়ঙ্কর মহিলা (পলাশের মা আরতি সাহা )! আমাদের কাছে টাকা পায়নি, তাই সারাদিন অত্যাচার করতো মেয়েটাকে, ঠিকমতো খেতেও দিত না, আমার তো টাকা পয়সা নেই এটাই আমার দোষ। আমার কোন কর্ম নেই, নিজের ওষুধ কেনার টাকাও নেই, মেয়েকে কোত্থেকে দেবো! ওই মহিলা চেয়েছিল ছেলেকে বিয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা আনবে সেটা না পেরে সারাদিন যন্ত্রণা দিত সুস্মিতাকে, আর নিজের স্ত্রীর অপমান সইতে না পেরেই আমার জামাই নিজেকে শেষ করে দিল। অনেক ভালো ছেলে ছিল পলাশ, সব সময় ফোনে আমাদের খোঁজ নিত, এটাও ছিল তার মায়ের কাছে দোষের!
বিয়ে হওয়ার দুই বছরের মধ্যে একবারও আমরা মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যেতে পারিনি, আমাদের কে ওই মহিলা সহ্য করতে পারত না।’’ সুস্মিতার চাচাতো ভাই ব্যাংকার পার্থ সাহা জানান, ১৮ বছর হওয়ার আগেই আমার বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় পলাশ। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পর ওর আগ্রহ দেখে আমরা বোনকে দিয়ে দেই। কিন্তু বিয়ের পর কোনদিন ওদের বাড়ি আমরা যেতে পারিনি, সব সময় শুনতাম বোনটাকে ওরা যৌতুকের জন্য অত্যাচার করে। কিন্তু পলাশের কথা সব সময় শুনেছি ভালো, সে আমার বোনকে অনেক ভালোবাসতো।
প্রতিবেশী ব্যবসায়িক চান্দু সরকার বললেন, সুস্মিতাদের পরিবারের সবাই খুব নিরীহ। ওর ছোট ভাই সৌরভ সাহা খুলনার কুয়েট ইউনিভার্সিটিতে লাস্ট সেমিস্টারে পড়াশোনা করছে। ওর বাবার টাকা নেই, তবুও ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করছে। কিন্তু লোভের কাছে আমাদের মেয়েটা জামাই হারালো।
সুস্মিতাদের পাশেই থাকেন গৃহবধূ দীপা সরকার। তিনি জানালেন, সুস্মিতা তার খালাতো ননদ। তিন দিন আগে মোবাইল ফোনে কথা হয় তার সাথে। সুস্মিতা বলেছিল ডাল রান্না খুব ভালো হওয়ায় তার প্রশংসা করেছিল পলাশ, সঙ্গে সঙ্গে খাবার টেবিলেই তার শাশুড়ি আরতি সাহা ডালের বাটি ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। সেদিন রাতেই সুইসাইডের জন্য এটেম নেয় সুস্মিতা। ফেসবুকে পোস্ট দেয়। সেই পোস্ট তার শাশুড়ি আরতি সাহার পিরাপিরিতে তুলে নিতে বাধ্য হয় সুস্মিতা।
আত্মহত্যার দিন সকালে অফিসে আসার সময় পলাশ সুস্মিতাকে জানালা দিয়ে টাটা দিয়েছিল, সেটা নিয়েও শাশুড়ি আরতি সাহা আক্রমণ করে সুস্মিতাকে। তার কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে শেষ করে দেয় পলাশ। চৌধুরী পাড়ার গৃহবধূ সাধনা সাহার দেবরের মেয়ে সুস্মিতা। সাধনা বলেন, ‘‘তার দেবরের টাকা পয়সা নেই, তাই শাশুড়ি সুস্মিতাকে ঠিক মত খেতে দিত না, অত্যাচার করতে সব সময়। আরতি সাহা সব সময় সুস্মিতাকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য মতলব করত, কিন্তু ছেলে ওকে ভালোবাসতো বেশি, তাই নিয়ে সংসারে অশান্তি ছিল।’’
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় র্যাব কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পলাশ সাহা ‘আত্মহত্যা’ করেন। বুধবার (০৭ মে) সকাল সাড়ে ১০টায় র্যাব -৭ এর নগরের বহদ্দারহাট ক্যাম্পে নিজ অফিস কক্ষে তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়।
পলাশ সাহার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। পারিবারিক কলহের জেরে পলাশ আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা পুলিশ কর্তৃপক্ষের। তার হাতে লেখা সুইসাইড নোটে লেখা আছে, ‘আমার মৃত্যুর জন্য মা এবং বউ কেউ দায়ী না। আমিই দায়ী। কাউকে ভালো রাখতে পারলাম না। বউ যেন সব স্বর্ণ নিয়ে যায় এবং ভালো থাকে। মায়ের দায়িত্ব দুই ভাইয়ের ওপর। তারা যেন মাকে ভালো রাখে। স্বর্ণ বাদে যা আছে তা মায়ের জন্য। দিদি যেন কো-অর্ডিনেট করে।’
(ডিসি/এসপি/মে ১০, ২০২৫)