ঈশ্বরদী প্রতিনিধি : পাবনার রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তাঁদের রূপপুর প্রকল্প ও গ্রিন সিটি বহুতল আবাসিক এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে পৃথক চিঠি দেওয়া হয়েছে। চাকরিচ্যুত ব্যক্তিরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন।

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান স্বাক্ষরিত এক পত্রে এই অব্যাহতির কথা জানানো হয়। এতে ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যেককে শনিবার রাতে ই-মেইলসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়।

প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস সত্যতা স্বীকার করে জানান, বিষয়টি সম্পর্কে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তায় দায়িত্বপ্রাপ্ত অথরিটির প্রধানকে অবহিত করা হয়েছে। তিনিও বিষয়টি জেনেছেন। এর বেশি তাঁর জানা নেই।

চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সূত্রে জানা গেছে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. মো. জাহেদুল হাছান স্বাক্ষরিত অব্যাহতিপত্রে কোম্পানির ১৮ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা ঢাকায় আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। অব্যাহতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রয়েছেন ১৫ জন বিএসসি এবং ৩ জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার।

অব্যাহতিপত্রে বলা হয়, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ইমপ্লইজ সার্ভিস রেজুলেশন’ ২০২৫ এর প্রবিধান ৫২.১ অনুযায়ী অব্যাহতি প্রদান করা হলো। একই সঙ্গে পৃথক আরেকটি পত্রে নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের রূপপুর প্রকল্প এলাকায় ও গ্রিণসিটিতে প্রবেশ বন্ধে অনুরোধ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে।

ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের মধ্যে উপ-সহকারী ব্যবস্থাপক রুবেল হোসেন জানান, এমডি ড. জাহেদুল হাসানের অপসারণসহ বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করায় আমাদেরকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জনৈক কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক স্পর্শকাতক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে রূপপুর প্রকল্প সার্বক্ষণিক আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার নজরদারিতে থাকে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আন্দোলন, সমাবেশ বিশ্বে নজিরবিহীন। নিরপত্তার শর্ত ভেঙে প্রকল্প এলাকায় মিছিল-সমাবেশ করে আন্দোলনকারীরা শুধু চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজই করেননি, প্রকল্পের অগ্রগতি ও পরবর্তী ধাপের লাইসেন্স প্রাপ্তিও হুমকিতে ফেলেছেন। ফলে, নীতিগত ভাবেই তাদের চাকুরিতে বহাল থাকার কোন সুযোগ নেই। তাদের অন্য কোন চক্রান্তে যোগসাজশ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পের কর্মীদের চাকুরী সংক্রান্ত অভাব অভিযোগ থাকতেই পারে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের হঠকারী আচরণে মনে হয়েছে তারা পরিকল্পিত ভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে মাঠে নেমেছে। নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের দাবির যৌক্তিকতা বিচার করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তা শুনতে নারাজ।

সূত্রটি আরো জানায়, এনপিসিবিএল এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকার মালিকানাধীন দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশী বেতন পেয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি জানান, এনপিসিবিএলে ৭ম গ্রেডের কর্মকর্তা সিনিয়র এসিটেন্ট ম্যানেজারের মূল বেতন ৭৫,৬০০ টাকা। বাড়ী ভাড়া ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ হারে ৩০,২৪০ টাকা থেকে ৪৫,৩৬০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ২৫০০ টাকা, স্পেশাল এলাউন্স ৫ শতাংশ হারে ৩৭৮০ টাকা এবং ৪০ শতাংশ প্রজেক্ট ভাতা ৩০২৪০ টাকাসহ সাকুল্যে ১,৪২,৩৬০ টাকা পান। এরসাথে ৪ শতাংশ ইনক্রিমেন্টও পান। একই ভাবে অন্যান্য গ্রেডের কর্মকর্তারাও সরকারী অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে অনেক বেশী বেতন পেয়ে থাকেন। তাস্বত্তেও তারা নানা দাবিতে আন্দোলন-হট্টগোল করেছেন। এমনকি নির্মাণ ও অর্থায়নকারী রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান ও কর্মকৌশল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও বিষোদগার করেছেন। যা এই প্রকল্পের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম চরম স্পর্শকাতর ও নিরাপত্তা বেষ্টিত নিউক্লিয়ার প্লান্ট এলাকায় এধরনের কর্মসূচি পালনের নজির বিশ্বে কোথাও নেই বলে জানিয়েছেন। এমন চলতে থাকলে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো বিপজ্জনক হয়ে যাবে। এধরণের ঘটনায় ইতোমধ্যেই আর্ন্তজাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বিস্মিত হয়েছে বলে জানান তিনি। প্রকল্পে সেফটি কালচার, সিকিউরিটি কালচার, কোড অব কন্ট্রাক্ট সবকিছু মেনে চলতে হবে। যেসব ঘটনা প্রকল্পে ঘটছে তা খুবই দুঃখজনক এবং পারমাণবিক কেন্দ্র শান্তিপূর্ণভাবে চালানোর ক্ষেত্রে অন্তরায়। বিষয়টি সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

এ বিষয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান বলেন, নীতিমালা ও চাকুরী বিধি অনুযায়ী অব্যাহতি প্রাপ্তদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর বেশী কিছু আমার বলার নেই।

প্রসংগত: বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ঈশ্বরদীর রূপপুরে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ গত ২৮ এপ্রিল থেকে আন্দোলন শুরু করেন। ৬ মে তাঁরা ঈশ্বরদী শহরে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেন। পরদিন ৭ মে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে কোম্পানির অফিসে তারা অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করেন। এতে এনপিসিবিএল কর্তৃপক্ষ তাঁদের চাকরিবিধি ও কোম্পানির আইন মেনে চলার জন্য চিঠি দেয়।

(এসকেকে/এসপি/মে ১১, ২০২৫)