পরিসংখ্যানের ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার বাস্তবতা
ওয়াজেদুর রহমান কনক
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা খাত একটি বিশাল ও বহুমাত্রিক বাস্তবতা বহন করছে। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি, বেসরকারি ও এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫,৫৯৬টি, যেখানে প্রায় ১ কোটি ৮৩ লাখ ৬৪ হাজার ৮৯০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। এই বিশাল শিক্ষার্থী জনগোষ্ঠীর জন্য দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় ৪ লাখ ২২ হাজারের বেশি শিক্ষক, যাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি নারী। সরকার ঘোষিত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হার প্রায় ৯৮.৫ শতাংশে পৌঁছালেও, UNESCO-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এখনও প্রায় ১৭ থেকে ১৮ লাখ শিশু বিদ্যালয়ের বাইরেই রয়েছে। ঝরে পড়ার হার ২০২২ সালের শেষে ছিল গড়ে ১৭ শতাংশ, এবং বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আসতে গিয়ে গড়ে ১০ জনের মধ্যে অন্তত ২ জন বিদ্যালয় ত্যাগ করে।
শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার গড়ে ৮১ শতাংশ হলেও প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক অঞ্চলে এই হার ৬৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত জাতীয়ভাবে গড়ে ১:৪৩ হলেও, কিছু এলাকায় এই অনুপাত ১:৭০ পর্যন্ত পৌঁছায়, যা মানসম্মত শিক্ষাদানে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এছাড়া ২০২১ সালের NAPE (National Academy for Primary Education) মূল্যায়ন অনুযায়ী, চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪৫ শতাংশ বাংলা ও গণিত বিষয়ে মৌলিক ধারণা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষকের পেশাগত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে রয়েছে অনেক বিদ্যালয়—প্রায় ২২ শতাংশ শিক্ষক এখনও পূর্ণাঙ্গ পেশাগত প্রশিক্ষণ পাননি।
এই সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি জাতির শিক্ষাব্যবস্থার ভিত কতটা দৃঢ় বা দুর্বল—তার নির্দেশক। এই বাস্তবতার আলোকে প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামো, সমস্যাবলী ও সম্ভাবনার উপর গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে, যেখানে শিক্ষানীতি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সাংস্কৃতিক রূচি ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান একসঙ্গে বিবেচনায় আনা জরুরি।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে জটিলতা ও সম্ভাবনার সহাবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল সকল নাগরিকের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও সার্বজনীন করা। সেই অঙ্গীকার থেকে নানা সময় শিক্ষা কমিশন গঠন, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে আজও শিক্ষা খাতের এই স্তরটিতে রয়েছে বিস্তর অসমতা, ঘাটতি ও কাঠামোগত দুর্বলতা।
দেশে প্রায় ৬৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখের বেশি শিশু। সংখ্যার দিক থেকে এটি এক বিশাল জনগোষ্ঠী হলেও মানের দিক থেকে চিত্রটি আশাব্যঞ্জক নয়। আজও প্রান্তিক অঞ্চল, বিশেষ করে চরাঞ্চল, উপকূল ও পার্বত্য এলাকাগুলোতে বিদ্যালয়ে শিক্ষক নেই, শ্রেণিকক্ষ নেই, এমনকি টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাও নেই। শহর ও গ্রামীণ বিদ্যালয়ের মধ্যে অবকাঠামোগত ও মানগত ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসেবে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ৮০ শতাংশের বেশি বলা হলেও বাস্তবে নিয়মিত উপস্থিতি অনেক কম। অনেক শিশুই পড়ালেখা বাদ দিয়ে কৃষিকাজ, হোটেলে কাজ কিংবা বাসাবাড়িতে শ্রমিক হিসেবে যুক্ত হয়—যার পেছনে রয়েছে দারিদ্র্য, পরিবারে শিক্ষা বিষয়ের অজ্ঞতা, কিংবা স্কুলে নিরাপদ পরিবেশ না থাকা।
এই অবস্থায় সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো শিক্ষক সংকট ও প্রশিক্ষণের অভাব। প্রায় প্রতিটি জেলায় সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে ঘাটতি রয়েছে। যেখানে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব ideally ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর হওয়া উচিত, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে একজন শিক্ষককে ৮০-৯০ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস পরিচালনা করতে হয়। এতে শিক্ষার গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শিশুরা প্রয়োজনীয় মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তার উপর অনেক শিক্ষকের নেই আধুনিক প্রশিক্ষণ, নেই শিশুবান্ধব পাঠদানের দক্ষতা। একঘেয়ে পাঠদান, মুখস্থনির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি শিশুদের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে এবং এক সময় তারা ঝরে পড়ে।
শিক্ষার মান নিয়ে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপেও দেখা যায়, একটি বড় অংশের শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গণিত ও বাংলা বিষয়ে প্রাথমিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। এমনকি তৃতীয় শ্রেণির শিশুদের একাংশই প্রথম শ্রেণির মানের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। এই ফলাফল আমাদেরকে একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়, যেখানে শুধু শিক্ষার্থীর সংখ্যা নয়, তাদের শেখার সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
তবে আশার কথা হলো—সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে গৃহীত কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের ফল ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। যেমন, 'প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৪ (PEDP-4)' এর মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যবই সরবরাহ, এবং শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার অনুযায়ী মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ই-লার্নিং পোর্টাল এবং শিক্ষকদের অনলাইন প্রশিক্ষণ প্রবর্তন করা হয়েছে। করোনা মহামারির পর স্কুলমুখী অনলাইন ও ডিজিটাল উদ্যোগ শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
তবে এই সম্ভাবনাগুলো বাস্তব রূপ দিতে হলে স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকে কাগজে-কলমে না রেখে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সামাজিক সংগঠন, পিতামাতার মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং স্থানীয় পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। শুধু প্রকল্পনির্ভর উন্নয়ন নয়, প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি, নীতিনির্ধারিত, গবেষণাভিত্তিক ও জনগণমুখী পরিকল্পনা, যার মাধ্যমে দেশের প্রতিটি শিশু মানসম্মত শিক্ষা লাভ করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে বহু বছরের অপূর্ণতা, অব্যবস্থা ও উপেক্ষা—অন্যদিকে রয়েছে ডিজিটাল অগ্রগতি, আন্তর্জাতিক সহায়তা, এবং নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। এই দ্বৈত বাস্তবতার মাঝে গবেষণামূলক বিশ্লেষণ ও লেখালেখির গুরুত্ব এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কারণ, ভবিষ্যতের শিক্ষা শুধু শ্রেণিকক্ষেই নয়—নীতি, সমাজ ও চিন্তার কাঠামোয় নির্মিত হবে।
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুর ঝরে পড়া একটি গভীর সামাজিক ও শিক্ষা-সংকটের প্রতিচ্ছবি। যদিও বিগত দশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেওয়া নানা পদক্ষেপের কারণে এই হার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, তবুও সমস্যাটি এখনও প্রকট। ২০২২ সালের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরে গড় ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ১৭ জন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছায় না। এই পরিসংখ্যান আরও গভীরতা পায় যখন দেখা যায়, সিলেট ও চট্টগ্রামের মতো কিছু বিভাগে এই হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে বরিশাল ও রংপুরে তুলনামূলকভাবে হার কিছুটা কম।
লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার মেয়েদের তুলনায় কিছুটা বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ছিল ১৬.১ শতাংশ, যেখানে ছেলেদের হার ছিল ১৮.৩ শতাংশ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিবারের দারিদ্র্য, পিতামাতার অশিক্ষা, শিশুশ্রমে নিযুক্ত হওয়া, বিদ্যালয়ের পরিবেশে আগ্রহের অভাব এবং শিক্ষক ঘাটতি—এই সবকিছু মিলিয়ে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার প্রবণতা বাড়ায়। বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক এলাকায় বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো দুর্বল, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত অস্বাভাবিকভাবে বেশি এবং পাঠদান পদ্ধতি শিশুবান্ধব নয়, যার ফলে শিশুরা বিদ্যালয়ে আকৃষ্ট হয় না।
বিশ্বব্যাংক এবং UNESCO-এর একাধিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে শিশুদের ঝরে পড়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী। অনেক শিশুর বাবা-মা তাদের আয় উপার্জনের উৎস হিসেবে দেখতে চান, বিশেষ করে শহরতলি ও গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার চেয়ে তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক লাভকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে বাল্যবিবাহ, স্থানান্তরের ফলে বিদ্যালয় ত্যাগ এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যা আরও কয়েকটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। UNICEF ও CAMPE-এর জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালে প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার অস্থায়ীভাবে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। দীর্ঘ সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফিরেই আসেনি। ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় অপ্রস্তুত পরিবারগুলো এই সময় শিশুদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়।
এই পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাগুলো কীভাবে বিনষ্ট হচ্ছে, তার প্রতিচ্ছবি। ঝরে পড়া রোধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, অর্থনৈতিক সহায়তা, বিদ্যালয়ভিত্তিক পুনরায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ এবং সবচেয়ে জরুরি, একটি শিশু-কেন্দ্রিক, আনন্দময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা। এই সংকট সমাধানে কেবল সরকারের নীতি গ্রহণ নয়, বরং সমাজের সবস্তরের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।