তপু ঘোষাল, স্টাফ রিপোর্টর : দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের চলমান ফেরিগুলোতে রাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জুয়ারি চক্র।

চক্রটি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ চক্রের সদস্য সংখ্যা অন্তত ২০/২৫ জন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রমতে, জুয়ার ফাঁদে পড়ে সাধারণ যাত্রীরা প্রতিনিয়ত নগদ টাকা, মোবাইলসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী খোয়াচ্ছেন। এক্ষেত্রে রাতের বেলায় ঝামেলা এড়াতে তারা পুলিশ বা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করতে আগ্রহী হয় না। ভুক্তভোগী বা অন্য কেউ কখনো জুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর করা এমনকি অস্ত্র প্রদর্শন করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দৌলতদিয়া -পাটুরিয়া নৌরুটে প্রতিরাতে ২ শতাধিক দূরপাল্লার নৈশকোচসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২ হাজার যানবাহন ও অসংখ্য যাত্রী পারাপার হয়। এদেরকে টার্গেট করে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত চলে জুয়াড়িদের তৎপরতা।

সূত্রমতে, জুয়ারি চক্র ঘাট থেকে ফেরি ছেড়ে দেওয়ার সময় কৌশলে ফেরিতে উঠে পড়ে। এরপর তারা ফেরির ডেকের এক কোনায় কুপি বাতি জ্বালিয়ে তিনতাস নামক খেলায় নিজেরাই লিপ্ত হয়। এরপর তারা লোকজনকে আকৃষ্ট করতে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘লাগলেই ডাবল, লাগলেই ডাবল’।

তাদের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই খেলতে বসে সর্বস্বান্ত হন। এরপর ফেরিঘাটের কাছাকাছি আসলে তারা বাতি নিভিয়ে মূহুর্তের মধ্যে লোকজনের মধ্যে মিশে যায়। কখনো কখনো ঘাটে কড়া নজরদারি থাকলে জুয়ারিরা ট্রলারযোগে চলমান ফেরিতে উঠে জুয়ার ফাঁদ পেতে বসে। এরপর ফেরিঘাটে ভেড়ার আগেই তারা ট্রলারযোগে ফেরি থেকে নেমে পালিয়ে যায়।

ঢাকা জেলার সাভার পৌর এলাকার রেডিও কলোনির বাসিন্দা ব্যবসায়ী সজীব চক্রবর্তী। ১৬ মে রাত ১২টার দিকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে ফেরিতে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। তিনি সাভার থেকে পাটুরিয়া হয়ে রাজবাড়ী যাওয়ার পথে ফেরিতে নদী পার হচ্ছিলেন। ফেরিতে ওঠার পর জুয়ার ফাঁদে ফেলে তাঁর কাছ থেকে ১১ হাজার টাকা ও একটি সোনার আংটি ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া অন্য যাত্রীদের টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে পালিয়ে যায় চক্রের সদস্যরা।

শুধু ১৬ মে নয়, এই নৌপথে রাতে চলাচলকারী ফেরিতে তিন তাস দিয়ে জুয়ার ফাঁদ পেতে যাত্রীদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবে আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে নিত্যদিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও বন্ধ হচ্ছে না জুয়া ফাঁদের ছিনতাই।

সজীব চক্রবর্তী বলেন, ‘ফেরিটি (খানজাহান আলী) পাটুরিয়া ঘাট ছাড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ১০-১২ জন লোক পেছন দিক থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত জেলে নৌকায় করে এসে ফেরিতে ওঠেন। একপর্যায়ে তাঁদের কয়েকজন কুপি (একধরনের বাতি) জ্বালিয়ে ফেরির ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনের মাঝের ফাঁকা স্থানে তিন তাস দিয়ে জুয়ার ফাঁদ পাতেন। যাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য প্রথমে তাঁরা নিজেদের লোকদের জিতিয়ে দেখান। তা দেখে আমিসহ কয়েকজন যাত্রী লোভের বসে তাঁদের পাতানো ফাঁদে ধরা দেওয়া মাত্র তাঁরা আমাদের টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন। মাত্র ৭ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে ফেরি থেকে নেমে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান তাঁরা।’

ফেরি খানজাহান আলীতে যাত্রীদের টাকা ও মালপত্র লুটের ঘটনার পর বিষয়টি সরেজমিনে দেখার জন্য এ প্রতিবেদক ১৭, ১৮ ও ১৯ মে রাতে ফেরি ভাষাশহীদ বরকত, ফেরি কেরামত আলী, ফেরি রুহুল আমিন, ফেরি খানজাহান আলী, ফেরি এনায়েতপুরী ও ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানসহ আরও কয়েকটিতে একাধিকবার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে যাতায়াত করেন। এ সময় তিন তাসের মাধ্যমে জুয়ার ফাঁদ পেতে যাত্রীদের টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন তিনি।

১৮ মে রাত ৯টার দিকে ফেরি ভাষাশহীদ বরকত দৌলতদিয়ার উদ্দেশে পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ঘাট ছাড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ৫ থেকে ৭ জন ছিনতাইকারী ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে এসে ওই ফেরিতে ওঠে। এরপর তাঁরা তিন তাস দিয়ে জুয়ার ফাঁদ পেতে যাত্রীদের আকৃষ্ট করে তাঁদের টাকা ও মালপত্র লুটে নেয়। এ সময় যাত্রী ও যানবাহন শ্রমিকদের অনেকে সেখানে উপস্থিত থাকলেও ভয়ে ছিনতাইয়ের শিকার যাত্রীদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে যাননি। তবে খবর পেয়ে পাটুরিয়া নৌ-ফাঁড়ি পুলিশের একটি দল ওই ফেরিতে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের আমজাদ মণ্ডল (৪২) ও জহির ফকির (৪১) নামে দুই ছিনতাইকারীকে আটক করে। বাকিরা ফেরি থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যায়।

জানতে চাইলে ফেরি ভাষাশহীদ বরকতের মাস্টার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে প্রায় প্রতি রাতেই বিভিন্ন ফেরিতে তিন তাস দিয়ে জুয়ার ফাঁদ পেতে যাত্রীদের টাকা ও মালপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। দুর্বৃত্তরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে এসে এক ফেরিতে লুটপাট করে আবার আরেক ফেরিতে ওঠে। এভাবে প্রায় সারা রাতই তাণ্ডব চালায় তাঁরা। কিন্তু সে তুলনায় পুলিশের তৎপরতা খুবই কম।’

১৯ মে রাতে পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া যাওয়ার পথে ফেরি কেরামত আলীতে ছিনতাইয়ের শিকার যাত্রী শাজাহান মিয়া বলেন, ‘আমি দেখলাম ফেরির ওপরে অন্ধকার জায়গায় কয়েকজন লোক তিন তাস দিয়ে খেলছেন। যাঁরা খেলছে তাঁরা হারছেন আর যাঁদের খেলাচ্ছেন তাঁরা জিতছেন। আমার মতো আরও কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। লোভে পড়ে আমরাও খেলি; কিন্তু আমরা জিততে পারিনি।’

শাজাহান আরও বলেন, ‘টাকা হেরে যাওয়ার পরও আমার পকেট থেকে ওরা মানি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। মানি ব্যাগে ৬ হাজার টাকা ছিল। আমি ওদের আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম। ওরা ছুরি দিয়ে আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করলে আমি ছেড়ে দিই। এরপর আমি ওদের ধরার জন্য চিৎকার করে উপস্থিত লোকজনের সাহায্য চাইলাম; কিন্তু ভয়ে কেউ এগিয়ে এল না।’

বিষয়টি ফেরি কেরামত আলীর দ্বিতীয় মাস্টার একলাস উদ্দিনকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এটা দৈনিক রাতের ঘটনা। মাঝে ওদের উৎপাত একটু কমেছিল। কিন্তু কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে আবার বেড়ে গেছে।’ একলাস উদ্দিন আরও বলেন, ‘চক্রের ৭ থেকে ১০ জনের একটি দল রাতে ইঞ্জিনচালিত জেলে নৌকা নিয়ে নদীতে অবস্থান করে। যেখানে জালসহ মাছ ধরার সব সরঞ্জাম থাকে, যাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন দেখলে মনে করে তারা জেলে। বাকিরা ভাগ হয়ে ৪ থেকে ৫ জন করে প্রতিটি ফেরিতে অবস্থান নিয়ে নজরদারি করে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ফেরি থেকে নদীতে থাকা দলকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়। এরপর নদীতে থাকা দলের সদস্যরা ফেরিতে উঠে যাত্রীদের টাকা ও মালপত্র ছিনিয়ে নেয়।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা এরিয়া অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো সুফল পাচ্ছি না। এ অবস্থায় সর্বশেষ ১২ মে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ নৌ পুলিশকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাটুরিয়া নৌ ফাঁড়ি পুলিশের ওসি কে এম নজরুল বলেন, ‘একটি সংঘবদ্ধ চক্র ফেরিতে তিন তাস দিয়ে জুয়ার ফাঁদ পেতে যাত্রীদের টাকা ও মালপত্র লুটে নেয়। এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আমরা তাঁদের দমনে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

(টিজি/এএস/মে ২৬, ২০২৫)