শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : সুমিষ্ট স্বাদে বিভোর প্রকৃতির রসগোল্লা খ্যাত দিনাজপুরের লিচু। প্রতি মৌসুমে কমপক্ষে একমাস, মুঠোফোনে লিচু নিয়ে থাকে উৎপাত! কর্মরত প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কর্মকর্তা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত এবং অপরিচিত ব্যক্তিরাও কুশল বিনিময়ে দিনাজপুরের লিচু'র স্বাদ গ্রহণ করতে চায়। বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিবে বলেও কেউ কেউ জানায়। কিন্তু, লিচু পাবার পর খেয়ে সেই টাকা পাঠাতে অনেকেই ভুলে যায়। কেউ কেউ নিখোঁজ হয়! তাই, মুঠোফোনে জেলার বাইরের অথবা অপরিচিত কারো কল আসলেই পিলে চমকে যায়। এমনই মন্তব্য দিনাজপুরে অবস্থানরত ভুক্তভোগী অনেকেরই।

প্রকৃত পক্ষে মৌসুমের শুরুতে অনেক গাছেই লিচু পাকার আগেই বিক্রি হয়ে যায়। এটা অজানা থাকে অনেকেরই। ওষুধ, বীজ, সার, কীটনাশকসহ বিভিন্ন নামী-দামী কোম্পানি, ব্যাংক-বীমা, এনজিও এবং সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা,ঠিকাদার, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক নিজের অবস্থান ধরে রাখতে বা বস-স্যারদের মন যোগাতে, খুশি রাখতে, পাকার আগেই চড়া দামে লিচু ক্রয় করে নেয় গাছেই। পরে তা গাছ থেকে নামিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়। যে দপ্তর, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছে লিচু পৌঁছে, তার চাহিদার চাইতে কয়েক গুণ বেশি লিচু পাবার পর তা খেতে না পারায় পঁচে বিনষ্ট হয়, সেই স্বপ্নের সুস্বাদু লিচু! অথচ, যারা পাঠায় তাদের অনেকের পরিবার সদস্যদের মুখে ওঠে না সেই চড়া দামের লিচু!

এই লিচু'র কারণে আবার অনেককে বিপাকে পড়তে হয়। কর্মরত প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কর্মকর্তা, আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত অপরিচিত ব্যক্তি'কে লিচু পাঠাতে না পেরে বা তাদের মন যোগাতে না পারায়। এজন্য অনেককে খেসারতও দিতে হয়। লিচু দিলে প্রমোশন আর না দিলে ডিমোশন, লিচু দিলে কারো কারো নিউজ লিড হয়,না দিলে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ অজানায় থেকে যায়।

প্রতি মৌসুমে এভাবেই অনেকই পড়ে লিচু বিড়ম্বনায়। যাদের সাংসারিক হিসেবের টাকা,নুন আনতে পান্তা ফুরায়- তাদের জন্য এটি খুবই কঠিন সময়।

প্রচন্ড তাপদাহ আর ঝড়-বৃষ্টিতে এবার লিচু খাওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হবে অনেকেরই। চড়া দামের কারণে অনেকেই মুখে উঠছেনা লিচু। বাগানে গিয়ে হাই কোয়ালিটি ১০০ বেদানা লিচুর দাম ৮০০ টাকার নিচে নেই। এদিকে ৫০০ লিচুর একটা ক্যারেট কুরিয়ার সার্ভিস চার্জ ৪০০/৫০০ টাকা, ক্যারেট ১২০ টাকা লোকাল প্যাকেজিং, ট্রান্সপোর্টেশন ১০০ টাকা হলে লিচুর মূল্য কতো দাঁড়ায়?

শুধু তাই নয়, এ লিচু কুরিয়ারে বাইরে পাঠাতে অনেক ঝুট-ঝামেলায় পড়তে হয়। খাঁচায় ভোরানো,খাঁচা বাঁধাই, কুরিয়ারের নির্দিষ্ট টোকেনে ঠিকানা লিখে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে বুকিং দিয়ে হয় লিচু। এই প্রচন্ড তাপদহনে ঘেমে একাকার হয়ে যায় লিচু প্রেরণকারীবা। টাকার চাইতে এই দুর্ভোগ অনেকের কাছে বেশি চরম অসহনীয়।

তারপরও কথা থেকে যায়। কুরিয়ারে এই লিচু নির্দিষ্ট স্থান বা ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে ৩ থেকে ৫ দিন সময় লেগে যায়। যার কারণে অনেক লিচু গরমে পঁচে গলে নষ্ট হয়ে যায়। লিচু'র প্রকৃত স্বাদ থেকেও বঞ্চিত হয় প্রাপকেরা। আবার অনেক সময় কুরিয়ারে লিচুর খাঁচা বদল হয়ে যায়।একজনেরটা অরেক জনের কাছে। কখনো আবার কুরিয়ার লিচুর খাঁচা প্রাপকের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।

অনেকে আবার বলে কুরিয়ার নয়,ঢাকাগামী যে কোন যাত্রীবাহী পরিবহনে হবে দিলেই। জানিয়ে দিলে নামিয়ে দিবো আমি গিয়েই। তারা কী জানে-যাত্রীবাহী পরিবহনে এক ক্যারেট লিচু পাঠাতে কতো নেয়? একজন যাত্রীর চেয়েও বেশি টাকা লাগে সেখানেই। তারপরও লিচু পৌঁছাবে কিনা সন্দেহ থাকে তা নিয়েও সন্ধিহান থাকতে হয়। তারপরও অনেক কষ্ট করেও কেউ কেউ পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু, যে নিতে আসবে তার কোন খোঁজ নেই। ভাবে, লিচু পাবো যে কোন সময় গেলেই। কিন্তু সেই লিচু খোয়া যায় অনেক সময়।

তারপরও এই চরম দূর্ভোগ আর লড়াই করে যে লিচু প্রাপকের কাছে পৌঁছানো হয়, সেই লিচুর যে মুল্য দাঁড়ায়, তার অর্ধেকেরও কম মূল্যে নিজের এলাকা থেকে লিচু ক্রয় করে খেতে পারেন যে কেউই। কিন্তু, তারপরও- কথা থেকে যায়! হায় রে হায়!

(এসএস/এসপি/জুন ০১, ২০২৫)