ফরিদপুরে পুলিশের সোর্স পরিচয়ে সর্বস্ব হাতিয়ে নেন জনৈক নিবর

রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : ফরিদপুরে পুলিশের সোর্স পরিচয়ে স্থানীয়দের জিম্মি করে সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়া, নানাভাবে চাঁদাবাজি ও হয়রানির মত বেশকিছু ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে জনৈক নিরব (২৩) নামের এক যুবক। নিরব ফরিদপুর কোতয়ালি থানার কৈজুরি ইউনিয়নের সাচিয়া গ্রামের জনৈক হাবি নামের এক নিঃসন্তান ব্যক্তির পালিত পুত্র বলে স্থানীয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সম্প্রতি পুলিশের সোর্স পরিচয় বহন করে তার সাথে সিভিল ড্রেসে কিছু লোকজন রেখে বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তি, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল টার্গেটেড ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিকভাবে অসহায় ব্যক্তিবর্গকে জিম্মি করে অনেক টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে নিরবসহ বেশ কয়েকজন সোর্সের বিরুদ্ধে।
রবিবার (১ জুন) দুপুরে ও একই দিন সন্ধ্যায় পল্লীকবি জসিমউদদীনের জন্মস্থান (মাতুলালয়) তাম্বুলখানা এলাকায় দুটি পৃথক পৃথক স্থানে দুই ব্যক্তিকে জিম্মি করে নগদ প্রায় ১ লাখ টাকা ও ২৪০ পিস ইয়াবা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয় নিরব ও তার কথিত পুলিশ টিম। নিরব রবিবার দুপুরে প্রথম ঘটনাটি ঘটায় তাম্বুলখানা কৃষি ফার্মের নিকটবর্তী এলাকায়। এসময় সে পুলিশের সোর্স এবং তার সাথে থাকা একজনকে পুলিশের এসআই ফারুক নামে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার টিম একাধিক মাদক মামলা থাকা এক ব্যক্তিকে ধরে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। পরে দেন দরবার করে তার থেকে ২৪০ পিস ইয়াবা ও নগদ ৬০ হাজার টাকা নিয়ে তার হাতকড়া খুলে দিয়ে চলে যায়। ঘটনার পর বিষয়টি জানাজানি হলে ফরিদপুরের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে বিষয়টি শেয়ার করেন এই প্রতিবেদক।
পরে তাদের পরামর্শক্রমে ঘটনাটির বিস্তারিত জানতে ওই ভুক্তভোগি ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে জানান, 'আমি শুধু সোর্স নিরবকে চিনি। ওই টিমের একজনের নাম এসআই ফারুক বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নিরব। তবে জনৈক এসআই ফারুক ডিবিতে নাকি থানায় কর্মরত তা বলতে পারেননি ওই ভুক্তভোগি।
আগে মাদক ব্যবসা করতেন স্বীকার করে মামলা ও সংসারের কথা চিন্তা করে ওই ব্যবসায় আর জড়িত নন জানিয়ে ওই যুবক আরও বলেন, 'টোটাল ব্যাপারটা আমাকে জিম্মি করে করা হয়েছে। হয়তো এটি আমার অতীতের পাপের ফল। সবকিছুই আমাকে ম্যানেজ করে দিতে হয়েছে পরিবার, আত্নীয় স্বজন ও ভাই-ব্রাদারের সহযোগিতায়। আমার সখের বাইকটি বন্ধক রেখে, সুদে টাকা নিয়ে, ধার দেনা করে আমার তাদের চাহিদা মেটাতে হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, 'পুলিশ না হলে তারা হাতকড়া পাবেন কোথায়? কান্না জড়িত কন্ঠে ওই যুবক আরো বলেন আমি এই টাকা রিকোভার কবরো কেমনে?
এরপর নিরব ওই দিন সন্ধ্যায় একই টিম নিয়ে তাম্বুলখানা এলাকায় আরেক ব্যক্তির থেকে একই কায়দায় হাতিয়ে নেন নগদ ২৫ হাজার টাকা। গত ১ জুনের এই দুই ঘটনা ছাড়াও অভিযুক্ত নিরব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মানুষকে জিম্মি করে ফরিদপুর সদরের বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই হাতিয়ে নিচ্ছেন অঢেল টাকা।
এদিকে নিরব পুলিশের সোর্সের কাজ করেন এমন তথ্য কোতয়ালি থানা পুলিশ সূত্রে নিশ্চিত হওয়ার পর ফরিদপুর জেলা পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কথিত 'এসআই ফারুক' এর পরিচয় নিশ্চিত হতে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ বিষয়ে ফরিদপুর সদর ডিবি পুলিশের ওসি মামুন, কোতয়ালি থানার ওসি মো. আসাদ উজ্জামান ও জেলা পুলিশের ডিআইও-ওয়ান মো. শাহজালাল আলম নিশ্চিত করেন 'ফারুক' নামে ফরিদপুর জেলা পুলিশের সদর উপজেলা এলাকার কোন শাখায় এসআই বা এএসআই পদমর্যাদার কোনো পুলিশ সদস্য নাই। পরে ফরিদপুর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও নিশ্চিত করে করে ওই নামে তাদেরও কোনো কর্মকর্তা নেই। এরপর এই প্রতিবেদক নিরব এর নম্বর সংগ্রহ করে তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে সরেজমিন তার পালিত বাবার বসতবাড়ি সাচিয়া গ্রামে গিয়েও নিরব এর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয় এই প্রতিবেদক।
তবে এই প্রতিবেদককে ফরিদপুর জেলা পুলিশের একাধিক শাখা থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে এমন অভিযোগের কথা মাঝে মাঝেই লোকমুখে শোনা গেলেও কোনো ভুক্তভোগি লিখিত অভিযোগ না করায় এসব দুষ্কৃতকারি সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে ৫ আগস্ট (২০২৪) দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর একাধিক অসাধু সংঘবদ্ধচক্র ফোন কলের মাধ্যমে বা সরাসরি যোগাযোগ করে অনেকের থেকেই এমন টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়েছেন বা নিচ্ছেন বলে পুলিশের কাছেও একাধিক তথ্য রয়েছে। ওই কর্মকর্তারা এমন ঘটনাগুলোকে পুলিশ সদস্যদের জন্য উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করে স্থানীয় জনগণকে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের সাথে কথা বলতে পরামর্শ দিয়েছেন।
এছাড়া, ফরিদপুরের কোনো পুলিশ কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে মাদকসহ আটক করে তার থেকে টাকা খেয়ে ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তাঁরা জানান, পুলিশ পোশাক ছাড়া বা পরিচয় গোপন করে এসব অভিযান কখনোই করেন না। আর যেখানে মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের ধরতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ সেখানে পুলিশদের দ্বারা এমন কাজ হবে সেটা ভাবাটা অমূলক উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তারা আরো বলেন, কেউ সিভিল ড্রেসে গিয়ে এমন ঘৃণিত ও বেআইনি কাজ করলে তাদের সনাক্ত করে সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা জননিরাপত্তা ও শৃঙ্খলায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবগত করার অনুরোধ করেন। তাঁরা বলেন, এমন অপ্রীতিকর ও আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের রহস্য উন্মোচন করে, পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা ব্যক্তিদের চিহৃিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। এসব ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবেনা বলেও জানান তাঁরা।
(আরআর/এসপি/জুন ০৩, ২০২৫)