রিয়াজুল রিয়াজ, ফরিদপুর : ফরিদপুরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সংঘবদ্ধ হামলার শিকার হয়েছেন সুমী আক্তার (২৫) নামের এক গৃহবধূ, এমনটিই অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীর পরিবার। হামলায় সুমী আক্তারের মাথায় মারাত্মক জখম হলে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

গত বুধবার বিকেলে ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের কাশিমাবাদ গ্রামে ওই হামলার ঘটনা ঘটে অভিযোগ করেন তারা। অপরদিকে সুমীকে হামলার সাথে তিনি ও তার পরিবার জড়িত নন বলে জানিয়েছেন সুমির স্বামী রিমন শিকদার (৩০)।

ভুক্তভোগী সুমীর বাবার বাড়ীর এলাকা ও একই ইউনিয়নের রণসিংহদিয়া গ্রামের এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, বুধবার সন্ধ্যায় একটি ভ্যান গাড়ি যোগে রক্তাক্ত অবস্থায় সুমি বাবার বাড়ীতে আসলে, তাকে দ্রুত ফরিদপুর মেটিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

আজ শুক্রবার সকালে এ বিষয়ে সুমীর বাবা সহিদ মাতুব্বর জানান, 'আমার মেয়ে সুমীকে গত রমজানে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেয় সুমীর স্বামী কাশিমাবাদ গ্রামের মৃত সোহরাব শিকদারের ছেলে রিমন শিকদার (৩০)। সুমী ও রিমনের সংসারে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। সন্তানদের জোর করে নিজের কাছে রেখে দেয় রিমন শিকদার।'

তিনি আরো বলেন, 'অভিমানে আমার মেয়ে এতোদিন শ্বশুরবাড়ীতে যায়নি। বাচ্চাদ্বয় ও স্বামীকে দেখার উদ্দেশ্যে গত ১০ জুন সুমী শ্বশুরবাড়ীতে যান। এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরের দিন সন্ধ্যায় সুমীর ওপর হামলা করে লিমন ও তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা। তাদের সংঘবদ্ধ হামলায় সুমি মারাত্নকভাবে রক্তাক্ত জখম হয়।'

এদিকে ওই হামলায় কে কে জড়িত ছিলেন তাদের নামগুলো রক্তাক্ত জখম অবস্থায় আহত সুমীকে হাসপাতালে নেওয়ার পর ও তার সেখানে জ্ঞান হারানোর পূর্বে ক্যামেরার সামনে উল্লেখ করেন।

উত্তরাধিকার ৭১ নিউজের হাতে আসা এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও থেকে সুমীর নিজ জবানিতে যেসব নাম বলতে শুনা যায়, তা হলো- রিমনের ফুপু ফিরোজা বেগম ও পারুলি বেগম, দাদী আকিরন নেছা, ফুফাতো বোন রহিমা আক্তার ও ফাহিমা আক্তার এবং সুমীর স্বামী রিমন শিকদার প্রমুখ হামলাটি চালান বলে ওই ভিডিওতে উল্লেখ করেন আহত সুমী আক্তার।

শুক্রবার সকালে সরেজমিনে রিমনের এলাকায় গেলে রিমন এসব অস্বীকার করে বলেন, 'আমি তাকে (সুমী) গত রমজানে ডিভোর্স দিয়েছি। তবুও সে ১০ জুন আমার বাসায় এসেছিলো, আমি বাসায় ছিলাম না। পরদিন (১১ জুন) বাসায় এসে তাকে দেখতে পাই। তখন আমি তাকে নিয়ে প্রতিবেশী ও স্থানীয় কানাইপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার রকিবুল আলম খান ওরফে আলম মেম্বারের বাসায় গিয়ে রেখে আসি। তারপরের ঘটনা আমি জানি না।'

এ বিষয়ে আলম মেম্বার বলেন, 'আমি ঘটনার দিন (১১ জুন) বিকেলে বাসায় গিয়ে দেখি রিমনের বউ সহ আমার বাসায় অনেক মহিলারা বসা। আমাকে লিমনের বউ সুমী আক্তার বলেন, 'আমি আর বাবার বাড়ীতে ফিরে যাবো না, আমি রিমনের সাথে সংসার করতে চাই।' তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, 'এভাবে তো হয়না, তোমার পরিবার নিয়ে এসো, সামাজিকভাবে বসো, আমি প্রয়োজনে তোমাদের বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে তোমাদের সংসার যোনো হয়, সেই ব্যবস্থা করে দিবো। তারপর আমি পথ খরচ দিয়ে সুমীকে বুঝিয়ে তার বাপের বাড়ীর উদ্দেশ্যে ভ্যানে উঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পরে শুনলাম তাকে নাকি হাসপাতালে ভর্তি করছে, কারা নাকি মেরেছে।'

তিনি আরো বলেন, কিভাবে সে রক্তাক্ত হয়েছে, অথবা কে বা কারা তাকে আঘাত করেছে সে সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানি না, তবে আমি যখন সুমীকে বিদায় দেই তখন তিনি অক্ষত ছিলেন।'

এদিকে, মেয়ের জামাই রিমন শিকদার তাঁর মেয়েকে অমানববিক নির্যাতন করেছে জানিয়ে এ বিষয়ে ভুক্তভোগী সুমী আক্তারের মা পারভীন বেগম জানান, 'আমার মেয়ে সুমীকে তার স্বামী ডিভোর্স দিয়েছে কিনা তা আমরা জানি না, এখনও এই বিষয়ে কোনো কাগজ আমরা হাতে পাইনি। তবে সুমী ও রিমনের সংসারের বেশ কিছুদিন যাবত ঝগড়া চলছিলো।'

এক প্রশ্নের জবাবে পারভীন বেগম আরো বলেন, 'সুমি আমাকে বলেছে রিমন অন্যত্র মেয়েদের সাথে মিয়মিত ফোনে কথা বলতো, এবং যৌতুকের জন্য তাকে নিয়মিত মার ধর করতো এবং এসব নিয়েই মুলতঃ ঝগড়াঝাটি বেশি হতো তাদের মধ্যে।'

তিনি জানান, আমি গরীব মানুষ এতো টাকা কোথা থেকে দিবো?' সুমীর মা আরো জানান, আমার মেয়ে রিমনের এক সহকর্মীর সাথে প্রেম করতো বলে অভিযোগ করতো রিমন। সুমী ও রিমন দম্পতির পরস্পরের এমন অভিযোগ নিয়ে এর আগেও একবার শালিস হয়েছিলো এবং ওই শালিসে সমাধান হয়ে আবার তারা ভালোভাবেই সংসার করতেছিলো। কিন্তু হঠাৎ গত রমজানের আগে আমার মেয়ের ওপর প্রায়ই অমানবিক নির্যাতন করতো রিমন।'

তিনি বলেন, আমাকে মেয়ে ফোন দিয়ে সব বলতো ও কান্দাকাটি করতো। খবর দিতো নিয়ে আসতে। কিন্তু সুমীর বাবা ও আমার একটাই কথা ছিলো, তোকে বিয়ে দিয়েছি, সংসার করার জন্য, তুই সংসার কর, জামাই যদি মেরেও ফেলে লাশ নিয়ে এসে মাটি দিবো। তবুও আমরা আনতে যেতাম না। আমরা বুঝি নাই রিমন ও তার পরিবার এতো হিংস্র হয়ে গেছে।'

মেয়ের জামাইকে উদ্দেশ্য করে পারভীন আরও বলেন, 'আমার কথা হলো তুই আমার মেয়ে যদি ডিভোর্স দিয়ে থাকোস, তাহলে একরাত তোর বাড়ীতে রাখলি কেনো বাবা? আবার পরের দিন অমানবিক অত্যাচার করে গুষ্টি সহ ওকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে বাড়ি পাঠাইলি কেনো?

রিমন শিকদার তার স্ত্রী সুমীকে তালাক দিয়েছেন উল্লেখ করে সুমীর সাথে ১০ জুন দিবাগত রাত কাটানোর কথা অস্বীকার করে জানান, 'সুমী যেই দিন (১০ জুন) আমার বাড়ীতে গেছেন, সেদিন আমি বাড়ীতেই ছিলাম না। আমি পরিবারসহ আত্নীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।

এদিকে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী সুমির বাবা সহিদ মাতুব্বর।

আজ শুক্রবার বিকেলে ওই অভিযোগের বিষয় জানিয়ে বাদী সহিদ মাতুব্বর জানান, আমার মেয়ে একা ওইখানে গিয়েছিলেন মঙ্গলবার। একরাত শ্বশুরবাড়িতে থেকেছেন। রক্তাক্ত অনস্থায় আমি আমার মেয়েকে পেয়েছি পরদিন সন্ধ্যায়। আমার মেয়ের কাছে বিস্তারিত শুনলে বুঝতে পারবেন আসল ঘটনা কি হয়েছিলো। ওইখানে কেউ সুমির পক্ষে কথা বলবে না, এলাকার পক্ষপ্রাতিত্যের কারণে।'

থানায় সহিদ মাতুব্বরের দেওয়া অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করে ফরিদপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদ উজ্জামান জানান, 'বৃহস্পতিবার (১২ জুন) রাতে সহিদ মাতুব্বরের থানায় এসে একটি অভিযোগ করেছেন। অভিযোগটির যথাযত তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে থানা পুলিশ।'

শুক্রবার সকালে সহিদ মাতুব্বরের অভিযোগের ভিত্তিতে কানাইপুর ইউনিয়নের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মানলাটির তদন্তের দায়িত্বে থাকা কোতয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো.

আব্দুল লতিফ। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে আব্দুল লতিফ জানান, সহিদ মাতুব্বরের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে।' তদন্ত শেষে এই ঘটনার বিস্তারিত জানাতে পারবেন বলেও জানান এসআই আব্দুল লতিফ।

(আরআর/এসপি/জুন ১৩, ২০২৫)