দিনাজপুরে দেশী টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনে মনির হোসেনের ব্যাপক সাফল্য

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : দিনাজপুরে আধুনিক প্রযুক্তিতে দেশী টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন সফল উদ্যোক্তা মনির হোসেন। আশপাশ ও দূর-দুরান্ত থেকে মৎস্য খামারিরা তার কাছে পোনা নিয়ে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ টেংরা মাছ চাষ করছেন। তার এই দেশিয় টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনের সাফল্য এখন অনেকের কাছে মৎস্য চাষের অনুপ্রেরণা।
মাছের নাম টেংরা। অন্যান্য মাছের তুলনায় টেংরায় কাঁটা কম হওয়ায় অনেকের কাছে বেশ প্রিয়। খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। তাই, মূল্যও বেশি। জলাশয় ও নদীতে নানা কারণে হারিয়ে যাওয়া দেশিয় এ টেংরা মাছ এখন পুকুরে চাষ হচ্ছে। আর এই টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের ইন্দ্রপুর গ্রামের পুকুরে। মনির হোসেন নামে এক প্রশিক্ষিত যুবক প্রতিবেশি মোক্তার আলীর কাছে ২৫ হাজার টাকায় ৫০ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে শুরু করেছেন, এই দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন। তিনি আধুনিক প্রযুক্তিতে টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন করে ৩ মাসে বিক্রির মাধ্যমে লাভ করেছেন লক্ষাধিক টাকা।
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের ইন্দ্রপুর গ্রামের নূরুল হকের ছেলে মনির হোসেন (২৮) এর সুখী পরিবার। বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী ও ছেলে সন্তান নিয়ে ৬ সদস্য নিয়ে তাদের বসবাস। পারিবারিক সূত্র বাবার কৃষিকাজের হাল ধরতে হয় তাকে। মনরি হোসেন বেশিদূর পড়াশোনা করতে না পারলেও কৃষি কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করতেন। ২০১৯ সালে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়ে সামান্য জলাশয়ে মাছ চাষ করেন এবং মাছে চাষে লাভের সম্ভাবনা আছে বুঝতে পারেন। এতে করে মাছ চাষের প্রতি তার আগ্রহ প্রবলভাবে বেড়ে যায় এবং কৃষি কাজের পাশাপাশি মাছ চাষ শুরু করেন। মনির হোসেন অভাবনীয় সফলতার মুখ দেখেছনে দেশী টেংরা মাছের পেনা উৎপাদনে।
মাছের পোনা উৎপাদন উদ্যোক্তা মনির হোসেন জানান, ৫০ শতক পুকুরে সর্ব সাকূল্যে তার খরচ হয়েছে ২ লক্ষ টাকা। এক বছরে তিনি মাছ বিক্রি করেন ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। নতুন করে তিনি চলতি বছরে আরো ২ একর পুকুর লিজ নিয়েছেন। বর্তমানে তার খামারে ৩ জন লোকের স্থায়ী কর্মসংস্থান এবং ৭ জন লোক অস্থায়ীভাবে কাজ করেছন। মাছের পোনা উৎপানের পাশাপাশি পুকুরের চার ধারে রোপণ করেছেন,ফলজ গাছ ও শাক-সব্জি। আশপাশ ও দূর-দুরান্ত থেকে মৎস্য বিক্রেতা ও
খামারিরা তার কাছে পোনা নিয়ে পোনা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য মাছ চাষ পরিবর্তন করে সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ টেংরা মাছ চাষ করছেন। তার এই দেশিয় টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনের সাফল্য এখন অনেকের কাছে মৎস্য চাষের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।
মুনিরের উৎপাদিত টেংরা মাছের পোনা নিতে আসা মৎস্য খামারি জহিরুল ইসলাম জানালেন, 'আগে অন্য মাছ চাষ করলেও তিনি এখন দেশি টেংরা মাছ চাষ করছেন। অন্য মাছের চেয়ে টেংরা মাছ চাষে লাভ বেশি।'
মাছের পোনা বিক্রেতা মকছেদ আলী জানালেন, 'মুনিরের পুকুর থেকে সপ্তাহে ৩/৪ দিন তিনি টেংরা মাছের পোনা হাড়িতে করে নিয়ে বাইরে বিক্রি করেন। এই টেংরা মাছের পোনার চাহিদা বেশি। অনেকে আগে থেকে অর্ডার দেন, পোনার জন্য। বিক্রি করে আমার লাভ ভালো থাকে।'
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন উদ্যোক্তা
মনির হোসেনকে এ বিষয়ে প্রথম থেকেই সহায়তা করে আসছে, মৎস্য বিভাগের পাশাপাশি গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র। গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের সূচনা মহিলা সমিতি-ভবের বাজার শাখার কারিগরি সহোযোগিতা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে মনির হোসেন টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম জানালেন, 'টেংরা মাছ খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় বাজারে এর মূল্য অন্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। এ মাছ চাষ করতে পারলে তুলনামূলকভাবে বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। ফলে পুকুর মালিকদের আয় বৃদ্ধিতে দেশি টেংরা মাছ বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে। শিক্ষিত বেকার যুবকেরা আধুনিক পদ্ধতিতে টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন ও মাছ চাষ করে বেকারত্ব ঘোচাতে পারছেন। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদন উদ্যোক্তা মনির হোসেনকে এ বিষয়ে প্রথম থেকেই সহায়তা করে আসছেন গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র।'
দিনাজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. তারিফুর রহমান সরকার জানালেন, উদ্যোক্তা মনির আমাদের সৃষ্টি। বেকার যুবকদের চাকুরির পিছনে না ঘুরে মাছ চাষের জন্য আহ্বান জানিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। পুকুরে টেংরা চাষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। যদি টেংরার সঠিক পরিচর্যা করা যায়, তাহলে একেকটি এলাকা থেকে যে পরিমাণ মাছের জোগান আসবে তাতে এ দেশীয় মাছের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হতে পারে। টেংরা চাষ করে যেমন কর্মসংস্থানের অভাব দূর করা যাবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে একে একটি লাভজনক খাতে পরিণত করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনে আমাদের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোও কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছে।
উদ্যোক্তা মনির হোসেনের এই দেশি টেংরা মাছের পোনা উৎপাদনে অনেকের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা পুরনের পাশাপাশি মাছ উপাদনে জাতীয় র্অথনীতিতে ভূমকিা রাখবে বলে মনে করনে অনেকেই।
(এসএস/এসপি/জুন ২৩, ২০২৫)