নওগাঁ প্রতিনিধি : মহান স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও নওগাঁর ধামইরহাটে পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত স্বাধীনতাকামী মানুষের গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো আজও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। গণকবরগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিলে কালের বিবর্তনে এক দিন দেশের মানচিত্র থেকেই এসবের স্মৃতিচিহৃ হারিয়ে যাবে। এলাকাবাসী এসব গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের জোর দাবী জানিয়েছেন। 

নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৫৬ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের কোল ঘেঁষে ধামইরহাট উপজেলার অবস্থান। স্বাধীনতা যুদ্ধে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাকি বাহিনী তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য রাজাকার, আলবদর ও আলসামস বাহিনী গঠন করে এলাকার মুক্তিকামী জনসাধারনের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। এসব বাহিনী কর্তৃক গণ নির্যাতনের ফলে এলাকার নিরীহ মানুষকে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকলে গ্রামবাসী দলে দলে প্রাণভয়ে উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এছাড়া এ পথ দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। তাই পাকি-হানাদাররা মুক্তি বাহিনীকে দেশে ঢুকতে না দিতে এবং দেশ থেকে ভারতে আশ্রয় ঠেকাতে এ উপজেলার ফার্শিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত অংশে সেনা ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তোলে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের শেষ দিকেই তারা এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এ দেশীয় রাজাকার, আলসামস ও আলবদর বাহিনী যোগ দিয়ে ব্যাপক নির্যাতন অগ্নি সংযোগ, নারীর সম্ভ্রম হরণসহ গণহত্যা চালিয়ে যায়। যদিও এ উপজেলা হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। কিন্ত তাদের নির্মম অত্যাচার এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে নিরীহ গ্রামবাসীদের ধরে এনে গুলি করে হত্যা করা হয় নির্বিচারে। অনেক লাশের পরিচয় না পাওয়ায় প্রধান সড়কের ধারে এবং ক্যান্টনমেন্টের আশপাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেক লাশ শিয়াল-কুকুরের পেটে যায়। গন্ধে ওই এলাকার আশপাশের বাতাস বিষাক্ত হয়ে ওঠেছিল।

এসব হত্যার নজির ফার্শিপাড়া গ্রামের দক্ষিণ ধারে দু’টি এবং উত্তরে বেশ কয়টি গণকবর রয়েছে। অন্যদিকে উপজেলার সীমান্তবর্তী কুলফৎপুর গ্রামের ১৪ জনকে একই দিনে কুলফৎপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে হানাদাররা। এই নির্মম ও বর্বরোচিত হত্যার পর তাদের লাশ যত্রতত্র পড়ে থাকলেও গ্রামবাসীরা পাকিসেনাদের সকল ভয়ভীতিতে উপেক্ষা করে লাশগুলো উদ্বার করে কোন রকমে মাটিচাপা দেয়। এস্থানটিতে উমার ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে পাকি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত ১৪ জন শহীদের একটি নাম ফলক স্থাপন করে।

অন্যদিকে এ উপজেলার পাগল দেওয়ান মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকায় নওগাঁ ও জয়পুরহাট জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমির স্মৃতি চিহৃ আজও মুছে যায়নি। গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো আজ গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ ৪৩ বছরে এগুলোর স্মৃতি ধরে রাখার কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি সরকারীভাবে। খোঁজ নেয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নিহত মানুষগুলোর অসহায় পরিবারগুলোর হাল হকিকত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব হত্যাকান্ডের কে কার খোঁজ রাখে? তাই নীরবে নিভৃতে গণকবর ও বধ্যভূমিগুলোর স্মৃতি চিহৃ দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে।

এব্যাপারে ধামইরহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার হোসেন আহমেদ বলেন, যে সব তাজা প্রাণ স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছে তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এলাকাবাসীর দাবী এসব বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সরকারীভাবে সংরক্ষন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। নচেৎ এক সময় তাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণত্যাগকারী মানুষগুলো সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের কোন ধারণাই থাকবে না।

(ওএস/এএস/ডিসেম্বর ১১, ২০১৪)