ল্যাম্পি স্কিনে বিপর্যস্ত রাজবাড়ীর খামারিরা

একে আজাদ, রাজবাড়ী : রাজবাড়ীতে ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ ধীরে ধীরে গবাদিপশু খাতে এক ভয়াবহ সংকট হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি খামারিরা পড়েছেন দিশেহারা অবস্থায়। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে দুধের বাছুর, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় মৃত্যুর হারও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এ রোগে আক্রান্ত গরু যেমন উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে, তেমনি খামারিরা পড়েছেন চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো- টিকা দিতে চাইলেও সহজে টিকা দিতে পারছে না।
জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ ল্যাম্পি স্কিনে আক্রান্ত গরুর মালিক। দেখা যায়, ঘরের পেছনের ছোট গোয়ালঘরে বাছুর গরুর গায়ে ফুসকুড়ির মতো গুটি উঠেছে, কারো কারো গুটি ফেটে গেছে, রক্তমাখা ক্ষতের মতো ভয়াবহ চিত্র। বাচ্চা গরুগুলো একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। অনেকেই দাঁড়াতে পারে না। কয়েকটি বাছুর ঘাস তো দূরের কথা, পানি পর্যন্ত খেতে পারছে না।
এ গ্রামে ইতোমধ্যে ৮টি দুধের বাছুর মারা গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় খামারিরা। বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
খামারিরা জানায়, এই রোগে আক্রান্ত হলে গরু ৩০-৪০ দিন পুরোপুরি অসুস্থ থাকে। এই সময় গরু দুধ দেয় না, খাবার খায় না, কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে আর্থিকভাবে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
স্থানীয় খামারি মো. বিল্লাল হোসেন জানান, আমার গাভিটা দিনে ১০ কেজির বেশি দুধ দিত। সেই গাভির বাছুরটা আড়াই মাস বয়সে হঠাৎ জ্বরের পর গায়ে গুটি দেখা দিল। ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করালাম কিন্তু আটদিনের মাথায় মরে গেল। এখন গাভিটাও দুধ দেয় না। বাছুর মারা যাওয়ায় সব নষ্ট হয়ে গেল।
তিনি আরও জানান, টিকার জন্য ডাক্তার বলল ১০টা গরু লাগবে। আমি ১০টা গরু যোগাড় করতে পারলাম না। তাই টিকাও দিতে পারলাম না। এটা কী ব্যবস্থা! এক গরুর এক টিকা হলে আমার গরুটা হয়তো বেঁচে যেত।
একই গ্রামের নারী খামারি সাদিয়া আফরিন জানান, আমার তিন মাস বয়সী বাছুরের গা জুড়ে এখনো গুটি। কিছু কেটে গেছে কিন্তু এখনও ভয়ংকর রকম ক্ষত। এক মাস ধরে চিকিৎসা করছি। ১২ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। এক সময় তো দাঁড়াতেও পারত না। এখন একটু দাঁড়ালেও ওর মুখের দিকে তাকালে কান্না আসে।
গোয়ালন্দ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের এআই টেকনিশিয়ান সাহাবুদ্দিন শেখ জানান, আমাদের উপজেলায় ব্যাপক হারে এই রোগ ছড়িয়েছে। দুধের বাছুর আক্রান্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমার ধারণা, আক্রান্ত বাছুরের ৪০ শতাংশই মারা যাচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক।
গত মঙ্গলবার রাজবাড়ী সদর উপজেলা পশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ভ্যানে করে বিভিন্নস্থান থেকে খামারিরা বাছুর নিয়ে এসেছে চিকিৎসার জন্য। তামিম হোসেন নামের এক খামারি জানান, আমার তিনটা গরু আক্রান্ত। বড় গরুগুলো একটু খাচ্ছে কিন্তু ছোট বাছুরটা খেতেই পারছে না, দাঁড়াতে পারছে না। তাই হাসপাতালে এনেছি। তিনি বলেন, টিকা নিতে গেলে বলে ১০টা গরু লাগবে। আমার আছে তিনটা। এখন বাকিটা কোথা থেকে আনব? এমন ব্যবস্থায় গ্রামের ছোট খামারিরা বঞ্চিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে রাজবাড়ী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস জানান, এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা মূলত মশা-মাছির মাধ্যমে ছড়ায়। তাই আক্রান্ত গরুকে আলাদা রাখতে বলছি, খামার পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দিচ্ছি। বাছুরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় মৃত্যু হার বেশি।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে বাজারে যেসব টিকা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো আমদানিকৃত এবং এক ফাইল টিকা ১০টি গরুকে দিতে হয়। এটা একটা সমস্যা। তবে দেশের গবেষণাগারে ইতিমধ্যে ল্যাম্পি স্কিনের টিকা তৈরির কাজ চলছে। বাজারে এলে টিকা সহজলভ্য হবে এবং এই সংকট কমে যাবে।
(একে/এসপি/জুলাই ১৩, ২০২৫)