চৌধুরী আবদুল হান্নান


মিথ‍্যা মামলা, হয়রানিমূলক মামলা সব সময়ই ছিল কিন্ত সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে গত এক বছরে। জুলাই অভ‍্যুত্থানে হত‍্যা মামলায় জড়িতদের বিচার করতে গিয়ে আজ বহু নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যা সকলেরই জানা।

মূল আসামির সংখ‍্যা যেখানে হাতেগোণা আর অজ্ঞাত আসামি অসংখ‍্য। এখানেই রয়েছে ব‍্যক্তিগত আক্রোশে নিরাপরাধ ব‍্যক্তিকে মামলার জালে ফাঁসানোর বড় সুযোগ এবং পুলিশসহ বিভিন্ন পক্ষের অর্থ আয়ের এক উর্বর ক্ষেত্র। মামলা বাণিজ‍্য চলছেই, সরকার বলছে সংক্ষুব্ধ ব‍্যক্তি যে কোনো লোকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। এটা তার অধিকার, সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। কিন্ত হাজারো নিরীহ মানুষের বিনা দোষে কারাভোগের মতো নির্মম দুর্ভোগ বন্ধে সরকারের কি কিছুই করার নেই? ভুলে যাওয়া ঠিক নয় যে, আইনের শাসন পরিপন্থি কর্মকান্ডের ভয়ংকর একটি পরিণতি রয়েছে যার দায় অবশেষে সরকারের ওপরই বর্তায়।

বহু কাঠখড় পুড়িয়ে এক মামলায় জামিন মিললেও অনেক সময় আসামিকে মুক্তি না দিয়ে কারাফটকে আরেক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

উপার্জনক্ষম পিতা-পুত্র যখন কারাগারে, সংসারের হাল যে কী হয় তা কেবল ভূক্তভোগীরাই জানেন।সহজে জামিন পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দালালচক্র আদালত পাড়ায় জাল পেতে বসে আছে, অনেকেই এ ফাঁদে পড়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খুইয়েছেন। গত এক বছরে মিথ‍্যা মামলা চালাতে গিয়ে জমি-জমা বিক্রি করে কত মানুষ যে নিঃস্ব হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই।

দুর্বল ব‍্যক্তি, জীবন যুদ্ধে পরাজিত ব‍্যক্তির খোঁজ কউ রাখে না, কারণ সে কারও কাজে আসে না।আইন প্রয়োগের শিথিলতার কারণে আমাদের দিন শুরু এবং শেষ হয় আতংকের মধ‍্য দিয়ে। অবস্থার উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, সার্বিক পরিস্থিতি ব‍্যবসা খাতকেও গভীর অনিশ্চয়তায় ফেলেছে বলে মনে করেন দেশের ব‍্যবসায়ীরা।

অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন ফরাসি বিচারক ও রাজনৈতিক দার্শনিক মন্টেস্কু (১৬৮৯ - ১৭৫৫) বলেছিলেন— “আইনের ছায়ার তলায় এবং বিচারের আবরণে যে অত‍্যাচার সাধিত হয় তার চেয়ে নিষ্ঠুর অত‍্যাচার আর নেই।”

দুই শতাব্দীরও অধিক সময় পূর্বের একজন ফরাসি বিচারকের এ মন্তব‍্য খুবই প্রসঙ্গিক এই কারণে যে, আজও সারাবিশ্ব আইনের শাসনের অভাবে ভুগছে।

কেবল হতাশা নয়, আশার কথাও আছে। সরকারের আইন উপদেষ্টা বলেছেন, মিথ‍্যা মামলা ও অযৌক্তিক গ্রেপ্তার কমাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান আনা হচ্ছে এবং সরকার ইতোমধ‍্যে মিথ‍্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ‍্য প্রণোদিত মামলা প্রত‍্যাহারের পদক্ষেপ নিয়েছে। আইন উপদেষ্টার কথায় আশার আলো দেখি। অন‍্যদিকে অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ না করে আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা ব‍্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্ত ‘২৪ এর গণঅভ‍্যুথ্থানের পর তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। অতি উৎসাহী কাজের মাধ‍্যমে অভ‍্যুত্থানের বার্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

গত বছরের আগস্ট হতে যতগুলো হত‍্যা বা হত‍্যা চেষ্টার মামলা হয়েছে, বিভিন্ন সংবাদ মাধ‍্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সেগুলোর উল্লেখযোগ‍্য অংশের উদ্দেশ‍্য নিরাপরাধ মানুষের হয়রানি।

সরকারের পক্ষ থেকে জোরেসোরে বলা হচ্ছে, ভুয়া মামলা কিংবা মামলার ভুয়া আসামিরা এখন থেকে প্রাথমিক তদন্তের পরই সংশ্লিষ্টতা না থাকলে রেহাই পাবেন। কিন্ত বড় সমস‍্যা অন‍্যত্র, মিথ‍্যা মামলা দায়েরকারীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার বিধান না করা হলে কোনো শুভ উদ‍্যোগ ফলদায়ক হতে পারে না।

সেক্ষেত্রে মামলা বাণিজ‍্য বা ভুয়া মামলার দৌরাত্ম‍্য বন্ধে এসব মামলার বাদীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে, বিদ‍্যমান আইন যথেষ্ট না হলে নতুন আইন করে তা প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় কাজের কাজ কিছু হবে না এবং এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের নেওয়া সকল উদ‍্যোগ ব‍্যর্থ হতে বাধ‍্য।

আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের ওপর মানুষের বাড়তি প্রত‍্যাশা রয়েছে, কারণ জুলাই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়ের আইনের এই অধ‍্যাপক যেভাবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তাতে মানুষের এ প্রত‍্যাশা অযৌক্তিক বলা যায় না। অনেকেই মনে করছেন, তিনি বর্তমানে অনেকটা গা বাঁচিয়ে চলছেন যা শুভ বার্তা দেয় না।

অনুসন্ধানী সাংবাদীকতায় আগ্রহী কোনো সাংবাদিক একটি গবেষণার উদ‍্যোগ নিতে পারেন, স্বল্প মেয়াদী অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আইন প্রয়োগে শিথিলতার কারণে কেবল হত‍্যা বা হত‍্যাচেষ্টা মামলায় মোট কতজন নিরীহ নিরাপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন, তার একটা পরিসংখ‍্যান বের করা। গবেষণাটি জাতির জন‍্য একটি সতর্ক বার্তা হিসেবে সংরক্ষিত হতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব‍্যাংক।