জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় জাতীয় ঐক্য ও গণজাগরণ জরুরি

আবীর আহাদ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালির আত্মত্যাগ, স্বপ্ন ও সংগ্রামের ফসল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, একটি চেতনার জন্ম দিয়েছিলাম—যেখানে থাকবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সর্বোপরি, মানুষের মর্যাদা। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে আজ আমরা যে বাস্তবতার মুখোমুখি, তা হতাশাজনক এবং ভয়াবহ।
আজ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করা হচ্ছে নানা প্রকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। তাঁর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ আজ পরিণত হয়েছে দুর্নীতি, দমন-পীড়ন ও লুটপাটের বধ্যভূমিতে। শহীদদের রক্তে লেখা ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের কাছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা পড়েছেন চরম অবহেলার শিকার—যাঁদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলেই আজকের বাংলাদেশ।
দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত, বিরোধী মত দমন করা হচ্ছে নির্লজ্জভাবে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত—বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, রাজনৈতিক নিপীড়ন এখন নিত্যদিনের চিত্র। মানুষের নিরাপত্তা নেই, নেই খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। অথচ ক্ষমতার অলিন্দে বসে একদল সুবিধাভোগী গোষ্ঠী মেতে আছে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার খেলায়।
সবচেয়ে দুঃখজনক ও ভয়ংকর হলো—রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। পেশাদার বাহিনী যদি রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হয়, তবে রাষ্ট্র তার ভারসাম্য হারায়, গণতন্ত্রের জায়গা নেয় কর্তৃত্ববাদ। এমন অবস্থায় দেশে যে কোনো সময় ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
এই অন্ধকার পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে কিছু ধূর্ত ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, যাঁরা ব্যক্তিগত লোভ ও ক্ষমতালিপ্সার কারণে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতাকেই বিপন্ন করে তুলেছে। জাতি আজ এক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
এই গভীর সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দলমত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে জাগতে হবে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে হবে।
আমরা নিম্নোক্ত জরুরি পদক্ষেপসমূহের জন্য জোর দাবি জানাই:
১. অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে, যাতে জনগণ তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
২. সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে পূর্ণ পেশাদারিত্বের আওতায় আনতে হবে, যেন তারা কেবলমাত্র দেশের সংবিধান ও জনস্বার্থের পক্ষে কাজ করে।
৩. দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে হবে, যেখানে প্রভাবশালী দুর্বৃত্তরা রেহাই না পায়।
৪. মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিত্তি করে সর্বস্তরে একটি শক্তিশালী জনতার ঐক্য ও গণজাগরণ গড়ে তুলতে হবে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের রূপরেখা তৈরি করবে।
এই সংকটে চুপ করে বসে থাকলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। তাই আমরা দেশপ্রেমিক সকল নাগরিক, তরুণ সমাজ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনসমূহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানাই।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।