ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বন্যায় এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতায় ডেঙ্গু মারাত্মক আকার নিয়েছে। বর্তমানে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চিকুনগুনিয়া, এবং জিকা ভাইরাস‑এর প্রাদুর্ভাব—যা একসঙ্গে দেশের জনস্বাস্থ্যে নতুন কোনো হুমকি নিয়ে এসেছে। এই রোগগুলো এক ধরনের যৌথ বিপদ তৈরি করতে পারে: এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া একটির পর একটির আক্রমণ হতে পারে। ফলে সামগ্রিক ঝুঁকি ও জটিলতা বেড়ে যায় যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় চাপ সৃষ্টি করে।

ডেঙ্গু: চলমান মহাবিধ্বংসী রোগ

সর্বগ্রাসী প্রাদুর্ভাব: ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রথমে ভয়াবহ রূপ নেয়, যেখানে ৩২১,১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি এবং ১,৭০৫ জনের মৃত্যু হয়, যা পূর্বের সকল বছরকে ছাপিয়ে যায়।

২০২৪–২০২৫ পর্যন্ত পরিস্থিতি: ২০২৪ সালে প্রায় ৯৩‑৯৬ হাজার, এবং ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার ভর্তি রোগী; মৃত্যুহার ৩১–৩৪ জন।

স্বাভাবিক চেয়েও দীর্ঘ মৌসুম: সাধারণত এই রোগ বর্ষাকাল (মে–সেপ্টেম্বর) তে বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মৌসুম বাদে সময়েও ক্ষেত্র মিলছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে।

কারণ ও প্রবণতা

শহরাঞ্চলে পানিতে পানি জমে থাকা, অপরিকল্পিত বাড়ি নির্মাণ, গচ্ছিত আবর্জনা—এগুলো মশা বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।

অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও দ্রুত নগরায়ন ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।

উপসর্গ ও ঝুঁকি

সাধারণ উপসর্গ: হঠাৎ জ্বর, মাথা ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, ক্লান্তি—কিছু ক্ষেত্রে ফুসকুড়ি ও বমিভাবও দেখা যায়।দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে জটিলতা যেমন ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার, প্লেটলেট হ্রাস, অর্গান বিকলন হতে পারে।

চিকুনগুনিয়া: নির্ভরযোগ্য তবে দমনযোগ্য রোগ

জানুয়ারি–মে ২০২৫: ঢাকায় ৩৩৭ নমুনা পরীক্ষায় ১৫৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে চিকুনগুনিয়ায়—চিকিৎসকরা শনাক্তের হার হিসেবে এটি ৪৫% মনে করছেন।

২০২৪ সালের তথ্য: সারাদেশে ৬৭ জন শনাক্ত—তার অধিকাংশই ঢাকার বাসিন্দা।

২০১৭ সালের বড় প্রাদুর্ভাব: সে বছর ঢাকায় প্রায় ১৩,৮০০ লোক চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হয়েছিল।

প্রভাব ও উপসর্গ

উচ্চ জ্বর, তীব্র জয়েন্টে ব্যথা (গিরায় গিরায় ব্যথা), ক্লান্তি, মাথা ব্যথা, সম্ভবত ফুসকুড়িও দেখা যায় ।অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নতির সময়ে ৭ দিনের মধ্যে ব্যথা কমে—কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে ২৮ দিন পরেও ৮১% রোগীর জয়েন্টে ব্যথা থাকে; কিছু ক্ষেত্রে ১–৬ মাস পর্যন্ত টিকতেই পারে। মৃত্যু হার অত্যন্ত কম এবং সাধারণত রিপোর্ট করা হয় না।

জিকা ভাইরাস: অবচেতন হুমকি গর্ভে

প্রথম শনাক্ত (মার্চ ২০২৫): ঢাকায় প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাসের গুচ্ছ সংক্রমণ পাওয়া গেছে, পাঁচটি ঘটনা শনাক্ত হয়—যা এশিয়ান লাইনেজের স্ট্রেইন।

২০২৪ সালের ডিজি এইচ এস–আইডিসিআর তথ্য: ওই বছর সারাদেশে ১১ জন জিকা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন—ডেঙ্গু পরীক্ষা করার সময় এই রোগ পাওয়া গেছে।

লক্ষণ ও প্রভাব

জিকার উপসর্গ আস্তে আসে—৮০% ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট উপসর্গ ধরা পড়ে না, যা রোগ শনাক্তকরণকে কঠিন করে তোলে।

উপসর্গ হিসেবে জ্বর, মাথা ব্যথা, গিঁটে ব্যথা, দুর্বলতা, কনজাংটিভাইটিস—এইসব ২‑৭ দিন স্থায়ী হতে পারে।

গর্ভবতী নারীদের জন্য বিরাট ঝুঁকি: মাইক্রোসেফালি সহ নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, গর্ভপাত, গুলেন–বারি সিনড্রোমের মত জটিলতা হতে পারে।

নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি বা ভ্যাক্সিন এখনও উপলব্ধ না—সুপারিশ ছাড়া চিকিৎসা উপসর্গ ভিত্তিক এবং বিশ্রাম, তরল গ্রহণ, উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।

পরীক্ষণ ও শনাক্তকরণ: সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ

ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় সাধারণত ডিএন/আরটি‑পিসিআর ও অ্যান্টিজেন/অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় করা হয়; তবে চিকুনগুনিয়া ও জিকার জন্য নির্ভরযোগ্যভাবে পিসিআর নিশ্চিতভাবে-আইইডিসিআরে করার ব্যবস্থাই সীমাবদ্ধ।

IgM ও IgG অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হয়—তবে সেনসিটিভিটি কম হওয়ায় ভুল অন্তর্নির্নয়ের সম্ভাবনা থাকে।

প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ: মশা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এটি ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়ার বাহক; তাই মৌলিক পদক্ষেপ হিসেবে আবাসস্থল পরিষ্কার করে রাখা অপরিহার্য।

পানি জমা রাখা বন্ধ করা, টব, বালতি, টায়ার ইত্যাদি নিয়ম করে পরিষ্কার করা, এবং অব্যবহৃত পাত্রগুলো মোছা জরুরি।

ঘরে মশানাশক স্প্রে, কয়েল, মশারি, জানালায় মশারি নেট ব্যবহার, দিনের বেলায় হালকা রঙের জামা প্যান্ট—সবই প্রতিরোধমূলক কৌশল।

জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ

বার্তালাপ ও একাত্ম প্রচারণা: জনসচেতনতা বাড়াতে মসজিদ, স্কুল, মিডিয়ার মাধ্যমে এডিস নিয়ন্ত্রণ, উপসর্গ চিনতে ও আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে উৎসাহ দিতে হবে।

পরীক্ষা ব্যবস্থার বিস্তৃতি: পিসিআর কিট অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি ল্যাবে সরবরাহ করে রোগ শনাক্তকরণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি।

ত্বরিত হাসপাতালে ভর্তি ও ব্যবস্থাপনা: রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসলেও—ঝুঁকিকে কমাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষ সতর্কতা: জিকার জন্য গর্ভ পর্যায়ে ট্রায়াল বা মনিটরিং সিকুয়েঞ্চ নিশ্চিত করা উচিত।

ভ্যাক্সিন ও গবেষণা: বর্তমানে ডেঙ্গু ও জিকা ভ্যাক্সিন উন্নয়নের দায়ে থাকলেও, ভবিষ্যতে প্রয়োগযোগ্য হলে তা দ্রুত জনস্বাস্থ্যে আনতে হবে; চিকুনগুনিয়া ভ্যাক্সিন গবেষণা পর্যায়েও আছে, তবে সময়সাপেক্ষ।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গু ভয়াবহতায় বৃদ্ধি পেয়েছে—বিশেষ করে ২০২৩ সালে সর্বকালের রেকর্ড। তবে সাম্প্রতিক বছরের চিকুনগুনিয়া পুনরায় সক্রিয়, এবং জিকা ভাইরাস‑এর দেখা পাওয়া যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। তিন ভাইরাসই একই মশা দিয়ে ছড়ায়; তাই মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে একটির চিন্তা করলেও অন্যদের প্রাদুর্ভাব অনিবার্য।পরীক্ষা সক্ষমতা সীমিত এবং রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসার কারণে মৃত্যু বাড়ছে। তবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরীক্ষার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে এই তিনটি রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

লেখক: চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।