স্বাধীনতা ও জাতিসত্তা রক্ষার লড়াইয়ে চাই জাতীয় ঐক্য

আবীর আহাদ
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল অজস্র ত্যাগ, রক্ত, বীরত্বগাথা এবং এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, ছিল জাতিসত্তা রক্ষার এক সর্বাত্মক সংগ্রাম। সেদিন পুরো জাতি সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে। বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর করুণ পরাজয় এবং রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ। এটি ছিল না কেবল একটি সামরিক বিপর্যয়; এটি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয়।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশ আজ গভীর আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে ঘেরা। একাত্তরের পরাজিত শক্তিগুলো—পাকিস্তানি ভাবধারা ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গোপন মিত্ররা—আজ ভিন্ন মুখোশে, ভিন্ন কৌশলে, আধুনিক প্রযুক্তি ও প্ররোচনার মাধ্যমে আবার সক্রিয়। তাদের লক্ষ্য একটাই: বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আত্মপরিচয় ধ্বংস করে দেশটিকে একটি বিভ্রান্ত, দুর্বল ও পরনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করা।
এই ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—তারা এদেশীয় কিছু সুবিধাভোগী, স্বার্থান্ধ, ক্ষমতালোভী এজেন্টের সহায়তায় রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলো দখল করে নিচ্ছে। অর্থ ও পদ-পদবির মোহে এসব লোক রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তির তাঁবেদারিতে নাম লিখিয়েছে। তাদের হাত ধরে চলছে জাতীয় ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের মহিমা মুছে ফেলা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আঘাত, এবং স্বাধীনতা ও বিজয়ের চেতনায় বিভ্রান্তি ছড়ানো।
এই অপশক্তির অন্যতম কৌশল হলো, জাতির আত্মপরিচয়ের শিকড় উপড়ে ফেলা। তারা চায়, নতুন প্রজন্ম হয়ে উঠুক ইতিহাসহীন, প্রেরণাহীন, আত্মবিস্মৃত এক জনসমষ্টি। ‘জয়বাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘স্বাধীনতা, 'বাঙালি'- এসব শব্দ যেন হয়ে উঠুক শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। কারণ ইতিহাসবিমুখ জাতিকে পরাধীন করা খুব সহজ।
কিন্তু ষড়যন্ত্র এখানেই থেমে নেই। তাদের শিকড় এখন আরও গভীরে বিস্তৃত। অর্থনীতি, শিক্ষা, অবকাঠামো, প্রযুক্তি, জ্বালানি, কূটনীতি ও সামরিক কৌশলের ভিতরে। সাম্প্রতিক কিছু ভূরাজনৈতিক চুক্তি, নিরাপত্তা সমঝোতা ও মার্কিন-নাটো ধাঁচের প্রভাব বিস্তারের তৎপরতা এ ষড়যন্ত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে। এসব কার্যকলাপে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ভৌগলিক অখণ্ডতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
এ ছাড়া জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিণত হয়েছে কায়েমি স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী তাদের ন্যায্য আর্থসামাজিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
আরও ভয়াবহ হলো—বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় আজ বিজাতীয় আগ্রাসনের কষাঘাতে ক্ষতবিক্ষত। পরিকল্পিতভাবে নতুন প্রজন্মের মাঝে এক বিকৃত ইতিহাস, পাশ্চাত্যনির্ভর সংস্কৃতি ও বিভ্রান্তিকর চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর পরিণতি হতে পারে—একটি চেতনাহীন, আত্মপরিচয়হীন, পরনির্ভর জাতির জন্ম।
এমন সংকটময় মুহূর্তে হতাশাজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার দাবি করা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনেকক্ষেত্রে দ্ব্যর্থপূর্ণ ও আপোষমূলক অবস্থান গ্রহণ করছে। কোথাও নীরবতা, কোথাও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে আত্মসমর্পণমূলক ভূমিকা—যা জাতির মৌল আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এই অবস্থায় আর কোনো বিলম্বের সুযোগ নেই।
এখন প্রয়োজন একটি সার্বজনীন, দলনিরপেক্ষ, আদর্শভিত্তিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীল জাতীয় ঐক্য— একটি এমন ঐক্য, যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, দেশ ও জাতির স্বার্থ হবে মুখ্য; একটি এমন ঐক্য, যা দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের দুর্গ হয়ে দাঁড়াবে।
এই ঐক্য গঠনে দায়িত্ব নিতে হবে—সচেতন নাগরিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, শিক্ষক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের। এটি নিছক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়—এটি জাতিসত্তা, আত্মমর্যাদা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্ন রক্ষার সংগ্রাম।
আজ প্রয়োজন আরেকটি ‘৭১’—তবে এবার রক্ত নয়, চাই চেতনা, তথ্য, বুদ্ধি, সাহস ও ঐক্যবদ্ধ প্রজ্ঞার যুদ্ধ। এই লড়াইয়ে জয়ী হতে না পারলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের চিনবে একটি পরাজিত জাতি হিসেবে।
দেশ আজ নতুন এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম হলো—সত্যকে চিনে নেওয়া, ষড়যন্ত্রকে বুঝে ফেলা, এবং সাহসিকতার সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের পথে এগিয়ে যাওয়া। এই লড়াইয়ে জয় নিশ্চিত করতে হবে। আর সেই জয় আসবে তখনই—যখন জাতি আবার এক হবে আদর্শের পতাকা তলে।
লেখক :মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।