নিজেকে বাঁচাতে মাকে দিয়ে বাদির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা সন্ধিগ্ধ আসামী রফিকুলের!

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝাউডাঙা ইউনিয়নের যোগরাজপুর গ্রামের সাবেক প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম মোস্তফার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তদন্তে উঠে আসায় মাকে দিয়ে ওই গৃহকর্তার বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিকার চেয়ে আবুল কালাম মোস্তফা সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
গত বছরের ১০ মে সাতক্ষীরা সদর থানায় দায়েরকৃত আবুল কালাম মোস্তফার ডাকাতি মামলা, আসামী ইয়ার আলীর আদালতে গত বছরের ৮ নভেম্বর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সদর থানার উপপরিদর্শক সোহরাব হোসেনের বক্তব্য থেকে জানা যায়, যোগরাজপুর গ্রামের অস্ত্র ও ডাকাতিসহ কমপক্ষে ৭টি মামলার আসামী সাদ্দাম হোসেন কারাগারে বসে সাবেক প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আবুল কালাম মোস্তফার বাড়িতে ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। এ জন্য যোগরাজপুর গ্রামের মহিবুল্লার মাধ্যমে কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামের আব্দুর জব্বার তরফদারের ছেলে কুখ্যাত ডাকাত ইয়ার আলীর সঙ্গে গত বছরের ৬ মে কারাফটকে সাক্ষাৎ করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ি ৯ মে দিবাগত রাত দুইটার দিকে বাড়ির গ্রীল কেটে আবুল কালাম, মোস্তফার বাড়িতে ঢুকে পড়ে ইয়ার আলী, আশাশুনির সুমন, যোগরাজপুরের মনিরুল, শ্যামলা রং এর পুলিশের চুলের ছাট দেওয়া ৩০ থেকে ৩৫ বছরের এক ব্যক্তিসহ ৬ জন। বাইরে আরো তিন জন অপেক্ষা করতে থাকে। একপর্যায়ে আবুল কালাম মোস্তফা ও তার স্ত্রীর হাত ও মুখ বেঁধে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আলমারি ও শোকেস ভেঙে ২৭ ভরি সোনার গহনা, ১৬ টি রুপার টাকা, দুটি মোবাইল ফোনসহ প্রায় ৩১ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়। এ সময় যোগরাজপুরের মনিরুল ফেলে যায় তার মোবাইল ফোনটি। যাহা পরদিন সকালে কৌশলে নিয়ে যায় ঢাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কর্মরত তার পুলিশ ভাইপো রফিকুল ইসলাম। মোবাইল নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি গৃহকর্তা আবুল কালাম মোস্তফা মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামী কালিগঞ্জের শংকরপুর গ্রামের ইয়ার আলী গত বছরের ৮ নভেম্বর আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে উল্লেখ করে যে তাদের সঙ্গে ডাকাতিতে সাদ্দামের চাচা মনিরুল ও অপর আসামী মনিরুলের সঙ্গে অজ্ঞাতনামা একজন যুক্ত ছিল তার গায়ের রং শ্যামলা, বয়স ২৯ বছরের মত হবে, তার বডি ফিগার ছিল পুলিশের মতো।
তবে সাদ্দামকে না ধরার জন্য এক পত্রিকা সম্পাদক আবু সাঈদ ডাকাতির মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তাকে মৃদু চাপ সৃষ্টি, আসামী রেজাউল জামিন পাওয়ার পর তদন্তকারি কর্মকর্তাকে থানা এলাকায় হুমকি, কবীর নামে এক ইউপি চেয়ারম্যান মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তাকে এক আসামী ধরার ব্যাপারে মোবাইলে মৃদু চাপ সৃষ্টির ঘটনা পুলিশের মনোবল ভেঙে দিচ্ছে বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা।
আবুল কালাম মোস্তফা বলেন, রফিকুল ইসলাম তার বাড়িতে ডাকাতির সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি তিনি বাস্তবে প্রমাণ করানোর জন্য মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা ও সাতক্ষীরা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে অবহিত করেন। বিষয়টি নিয়ে রফিকুল তার পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করলে তিনি পুলিশের মহা পুলিশ পরিদর্শকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন। অভিযোগ পাওয়ার পর সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ ইমরান হোসেন (আলফা-৩)তাকে কয়েকবার তার অফিসে ডেকে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন। একদিন রফিকুল ওই পুলিশ কর্মকর্তার অফিসের সামনে হাজির ছিলো। ওই কর্মকর্তার দিয়ে বিষয়টি মেটানোর চেষ্টা করে সে । যদিও তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করার কথা বলেন। এ ছাড়া পুলিশের এক কর্মকর্তাকে দিয়ে তাকে মোবাইল ফোনে রফিকুলকে নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর না হওয়ার ব্যাপারে তার উপর চাপ সৃষ্টির অভিযোগ করেন আবুল কালাম মোস্তফা।
তিনি আরো বলেন, তার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় রফিকুল যে ফেঁসে গেছে তা বুঝতে পেরে নিজেকে বাঁচাতে সব ধরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । একপর্যায়ে নিজে, নিজের বোন , ভগ্নিপতি ও কাছের এক মানুষকে সাক্ষী করে তার মা ফিরোজা বেগমকে দিয়ে চলতি বছরের ১০ মার্চ সাতক্ষীরার আমলী প্রথম আদালতে তাকে আসামী করে একটি মিথ্যা চাঁদাবাজির
মামলা করিয়েছে। গত ২৭ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম প্রণব কুমার হুঁই। প্রতিকার চেয়ে তিনি মহাপুলিশ পরিদর্শকসহ পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তার কাছে গত ১৫ মে আবেদন করেছেন। এ ছাড়া সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) মুকিত হাসান খান তাকে গত ২৭ ও ২৮ জুন তার অফিসে ডেকে তিনি গত ৮ ও ৯ জানুয়ারি কোথায় ছিলেন, তার আই ফোন থেকে অন্য কারো সিম ব্যবহার করে কোথাও কথা বলা হয়েছিল কিনা জানতে চান। তিনি আই ফোন ব্যবহার করেন না বলার পরও তিনি সত্য গোপন করছেন এমন কথা বলেন তিনি। রফিকুল এলাকার কামরুজ্জামান নামের এক সাংবাদিককে ব্যবহার করে বা পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে হয়রানি করার চেষ্টা করছে বলে তিনি মনে করেন।
এ ব্যাপারে কথা বলেতে শুক্রবার ফিরোজা বেগমের বাড়িতে গেলে জানা যায় তিনি লাবসা গ্রামের এক যুবকের হাতে মারপিটের শিকার হয়ে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চাঁদাবাজি মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সদর থানার উপপরিদর্শক মোঃ সাঈদুল ইসলাম বলেন, রফিকুল নিজে আবুল কালাম মোস্তফার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি বাদি ও পুলিশ নিশ্চিত হওয়ায় বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তার মাকে দিয়ে ডাকাতি মামলার বাদির বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা করিয়েছে মর্মে তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। খুব শীঘ্রই এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠানো হবে।
ডাকাতি মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সদর থানার উপপরিদর্শক সোহরাব হোসেন বলেন, মামলাটির প্রথম তদন্তকারি কর্মকর্তা ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক তুহিনুজ্জামান। তিনি এ মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামী হিসেবে বেল্লাল হোসেনসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেন। তার কাছে তদন্তভার আসার পর তিনি ইয়ার আলী, রেজাউল, মনিরুল, সাদ্দাম হোসেন, মহিবুল্লাহসহ ছয়জনকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেছেন। তিনি টিআই প্যারেটের ব্যবস্থা করে মামলার বাদিকে কারাগারে থাকা আসামী ইয়ার আলীকে সনাক্ত করানোর উদ্যোগ নেন। বাদি আবুল কালাম মোস্তফা ইয়ার আলীকে নিজের সততা ও দক্ষতায় সনাক্ত করেন। পরে সে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এ ছাড়া রেজাউল, সাদ্দাম, আশাশুনির রাধাপট্টির সুমন ও সর্বশেষ যশোরের শার্শার মহিবুল্লাহকে আদালতের মাধ্যমে প্রত্যেককে দুই দিন করে রিমাÐে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। রেজাউল ও সুমনের দেওয়া তথ্য মতে তাদের বাড়ি থেকে বাদির বাড়ি থেকে ডাকাতি হওয়া সোনার গহনা উদ্ধার করেন। যোগরাজপুরের পুলিশ সদস্য রফিকুল ইসলাম ডাকাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে কোন ক্লু পাওয়া গেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছু বলা যাবে না। ডাকাতির শেষে গত বছরের ১০ মে ভোরে রফিকুল তার চাচা মনিরুলের মোবাইল ফোন বাদির বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। ওই ফোন ডাকাতিকালে কোথায় মনিরুল রেখেছিল তা রফিকুলের জানার কথা নয়। এ ছাড়া ইয়ার আলী ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে নাম উল্লেখ না করেই ডাকাতিকালে শ্যামলা রং এর পুলিশের ফিগারের মত ব্যক্তিটি তার সঙ্গে অংশ নেয় সে যে সন্ধিগ্ধ রফিকুল ইসলাম সেটা প্রাথমিকভাবে ধারণা করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুকিত হাসান খান বুধবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদককে বলেন, সাতক্ষীরার এক ব্যক্তির মোবাইল ফোন হারিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত সাধারণ ডায়েরিকে ঘিরে তদন্তে আবুল কালাম মোস্তফার ব্যবহৃত একটি ফোনের এমই যাঁচাই করে হারানো সিমটি মোস্তফার ফোনে একবার ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে তিনি জানতে পেরে তাকে তার অফিসে ডাকিয়েছিলেন। এর সঙ্গে ডাকাতি মামলার সুপারভিশনের কোন সম্পৃক্ততা নেই।
(আরকে/এএস/জুলাই ৩১, ২০২৫)