শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : কখনো আনসার কমান্ডার,কখনো ইউএনও’র গানম্যান আবার কখনো বিজিবি সদস্য। একাই ভিন্ন ভিন্ন বাহিনীর পরিচয়ে গ্রাম-গঞ্জে আতংক ছড়ান তিনি। জেলে থেকে শুরু করে বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত তোলেন চাঁদা। অভিযান ও মামলার ভয় দেখিয়ে সাপ্তাহিক,মাসিকের পাশাপাশি বাৎসরিক চুক্তিতে জেলেদের কাছ থেকে আদায় করেন অর্থ। এমন অভিযোগ ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বিষ্ণুদিয়া গ্রামের লাল্টু হোসেনের বিরুদ্ধে।

একাধিক ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের লাল্টু হোসেন মৎস্য ও আনসার কর্মকর্তাদের দিয়ে চায়না দুয়ারি জালের অভিযানের ভয় দেখিয়ে শতাধিক জেলেদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে আসছেন। শুধু চাঁদাই না,জেলেদের কাছ নিয়মিত মাছও নিয়ে থাকেন তিনি। আর জেলেদের সাথে টাকার বিষয়ে দেনদরবার করার জন্য রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। অভিযানে জব্দ করা জাল না পুড়িয়ে কর্মকর্তাদের অগোচরে অন্য জেলের কাছে বিক্রি, নিজের কাছে রেখে দেওয়া, সেই জাল অন্য আরেকজনকে দিয়ে নদীতে পাতানো, অভিযানে কাজ করা সাধারণ শ্রমিকদের পারিশ্রমিক না দেওয়ার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে। এতসব অভিযোগ থাকলেও অভিযানের ভয়ে লাল্টুর বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায়না কোন জেলে।

জেলেদের কাছে নিজেকে মৎস্য ও আনসার কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠজন দাবি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে এসব অপকর্ম করেন তিনি। উপজেলাজুড়ে প্রায় শতাধিক জেলে তার কব্জায়। চুক্তি অনুযায়ী দেন টাকা। টাকা দিলে মোবাইল ফোনে অভিযানের খবর পৌছে যায় জেলেদের কাছে। সুযোগ বুঝে নদী থেকে জাল উঠিয়ে রাখেন ওই জেলে। টাকা দিতে হেরফের হলেই নিজের অনুগত অন্য জেলের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে অভিযান চালিয়ে তার জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেন। অভিযান পরিচালনা করতে নিজেই কিনেছেন ট্রলার। ভয়ভীতি দেখিয়ে অন্যের ট্রলার নিয়ে নেওয়ার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে। কখনও নিজ হাতে আবার কখনো বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিয়ে থাকেন এই লাল্টু। জালের পরিমাণ অনুযায়ী টাকা কমে-বাড়ে। এই প্রতিবেদকের হাতে আসা বিভিন্ন কল রেকর্ড এবং ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে লাল্টুর বিরুদ্ধে এসকল অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

এক সময়ের ফটো স্টুডিও’র মালিক লাল্টু এখন প্রতিমাসে শুধুমাত্র জেলেদের কাছ থেকেই আদায় করেন লক্ষ লক্ষ টাকা। স্টুডিও ব্যবসা ছেড়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে করছেন অপকর্ম। সামান্য আনসার স্বেচ্ছাসেবী হয়ে তার চাল-চলন যেন বড় কোনো সরকারি কর্মকর্তার মতো। চড়েন দামি মোটরসাইকেলে,করেছেন বিলাশবহুল বাড়ি। নদীতে অবৈধ চায়না দুয়ারি জালের অভিযানে কর্মকর্তাদের হাত করে নিজেও বনে গেছেন সরকারি কর্মকর্তা। মৎস্য কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আনসার কর্মকর্তা এমনকি অফিসের সবাই যেন তার হাতের মুঠোয়।

দামুকদিয়া গ্রামের ভুক্তভোগী জেলে আবুজার বলেন,‘সাপ্তাহিক ও মাসিক চুক্তিতে অভিযানের খবর ও জাল না পোঁড়ানো বাবদ লাল্টুকে টাকা দিয়েছি। টাকা দিতে দেরি হলে বা না দিলে কোথায় জাল পেতেছি তা অন্য জেলেদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে অভিযানের সময় জাল তুলে পুঁড়িয়ে দেয়।’

আরেক ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর বলেন, ‘পেটের দায়ে নদীতে এসব অবৈধ জাল পাতি। তার উপর আবার লাল্টু মামলার ও অভিযানের ভয় দেখিয়ে টাকা ও মাছ নেয়। কয়েকবার আমি জাল তোলা অভিযানে শ্রমিকের কাজ করেছি। টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দেয়নি। আবার পোড়ানো জালে থাকা লোহার শিক বিক্রি করেও সেই টাকা আত্নসাৎ করেছে। জাল বাঁচানোর জন্য আমরা তাকে টাকা দিয়েছি।'

নুর ইসলাম নামে আরেক জেলে বলেন,'আনসার কমান্ডার পরিচয়ে মামলা করার ভয় ও অভিযানের খবর দেওয়ার জন্য টাকা নিয়েও খবর দেয়নি। উল্টে আমার ৭টি জাল পুঁড়িয়ে দিয়েছে। অবৈধ জালের কারখানা বন্ধ করে দিলে আমরা আর এই জাল পাবো না,ফলে পাততেও পারবো না।’

তবে এতসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে লাল্টুর মুঠোফোনে কল দিলে লাল্টুর মেয়ে পরিচয়ে এক নারী ফোন রিসিভ করেন। লাল্টু হোসেনের পেশা কি জানতে চাইলে তিনি বলেন,তার বাবা একজন আনসার কমান্ডার। পরে লাল্টু হোসেন নিজে ফোন করলে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান এই প্রতিবেদক। সব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন,‘আমার বিরুদ্ধে জেলেরা মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছেন যাতে অভিযানে আমি না যাই। এলাকার সব জায়গা আমি চিনি,এজন্য অভিযানে জাল তুলতে সুবিধা হয়। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে। এক পর্যায়ে এই প্রতিবেদকের সাথে গোপনে দেখা করতে বলেন লাল্টু হোসেন।’

এবিষয়ে ৯নং মনোহরপুর ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা আনসার কমান্ডার শহিদুল ইসলাম বলেন,‘এলাকার অনেক জেলের কাছ থেকে লাল্টু হোসেনের টাকা নেওয়ার বিষয়ে শুনেছি। গোপনে তদন্ত করছি। সত্যতা পেলে উপজেলা আনসার কমান্ডারের কাছে জানাবো।’

লাল্টুকে নিয়ে এতসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শৈলকুপা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান এই প্রতিবেদককে লিখিত দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন,লাল্টুর বিষয়ে সাংবাদিকদের মাধ্যমে অভিযোগের বিষয়ে জেনেছেন। তবে লাল্টু তাদের সদস্য না। সে একজন স্বেচ্ছাসেবক। পূজা,ভোট বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাকে দিন হাজিরায় কাজ করানো হয়। অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন,‘সাংবাদিকদের মাধ্যমে সমস্ত অভিযোগের বিষয়ে জেনেছি। তদন্ত চলছে, প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযানে যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ সেই লাল্টু হোসেনকেই কেন নেওয়া হয় প্রশ্নে মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, তিনি স্থানীয় হওয়ায় সমস্ত কিছু ভালো চেনেন ও জানেন। এজন্য অভিযানে তাকে সাথে রাখা হয়।’

(এসই/এএস/আগস্ট ০৮, ২০২৫)