মো. ইমদাদুল হক সোহাগ


বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের এমন এক কৌশলগত সংযোগস্থলে অবস্থিত, যা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বাণিজ্য পথ, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন) এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই ভৌগোলিক বাস্তবতায় কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রেখে একে সুবিধাজনক অবস্থানে রূপান্তর করাই এখন বাংলাদেশের মূল চ্যালেঞ্জ। এর অর্থ হলো, আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক সংক্রান্ত নীতিগুলোকে কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে সমুদ্র, স্থলভাগ এবং সীমান্তজুড়ে বাস্তব ফলাফলে পরিণত করতে হবে।

ঢাকার ইন্দো-প্যাসিফিক রূপকল্প জোট-নিরপেক্ষ এবং শান্তিকেন্দ্রিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যার মূল লক্ষ্য অবাধ নৌচলাচল, স্থিতিশীল সরবরাহ ব্যবস্থা, সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং একটি টেকসই সুনীল অর্থনীতি নিশ্চিত করা। তবে বিশ্ব আমাদের নীতির সুন্দর উপস্থাপনা দিয়ে বিচার করবে না, বরং বাস্তব অগ্রগতি দিয়ে মূল্যায়ন করবে। আমরা যদি নিরাপদ বন্দর, দ্রুত পণ্য খালাস এবং পরিচ্ছন্ন জলসীমার নিশ্চয়তা দিতে পারি, তবে বাংলাদেশ বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত না হয়ে সমাধানের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

সমুদ্রের সুরক্ষাই প্রথম কাজ

বঙ্গোপসাগর একাধারে আমাদের বাণিজ্যের প্রধান ধমনী এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার প্রথম প্রতিরোধ ব্যবস্থা। একারণে মেরিটাইম ডোমেইন অ্যাওয়ারনেস (MDA) প্রতিষ্ঠা, কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অনুসন্ধান ও উদ্ধার (SAR) কার্যক্রমে আঞ্চলিক সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু উচ্চ ফলদায়ক বিনিয়োগ। সমন্বিত অপারেশনাল চিত্র, যৌথ মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণ (HADR) মহড়া, উপকূলীয় দেশগুলোর মধ্যে রিয়েল-টাইম হটলাইন স্থাপন এবং তেল নিঃসরণের মতো বিপর্যয় মোকাবিলায় আদর্শ পরিচালন পদ্ধতি (SOP) প্রণয়ন—এই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপগুলো কেবল জীবন বাঁচায় না, পারস্পরিক আস্থাও তৈরি করে। এগুলোকে ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে না দেখে দৈনন্দিন অনুশীলনে পরিণত করতে হবে।

সংযোগ যখন কৌশল

কানেক্টিভিটি বা সংযোগই বর্তমান বিশ্বের কৌশল। মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম ও মংলার আধুনিকায়ন এবং আন্তঃসীমান্ত রেল ও সড়ক নেটওয়ার্ক আমাদের লজিস্টিকস খাতের চিত্র বদলে দিতে পারে—যদি এর শেষ মুহূর্তের সংযোগ এবং নিয়মকানুন সঠিকভাবে কাজ করে। এক্ষেত্রে

তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

১. একক ব্যবস্থা (সিঙ্গেল উইন্ডো): কাস্টমস ও বন্দর কার্যক্রমে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম, যা দীর্ঘসূত্রিতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস করবে।

২. স্বচ্ছ মাশুল: ট্রান্সশিপমেন্ট ও অন্যান্য বন্দর পরিষেবার জন্য স্বচ্ছ এবং অনুমানযোগ্য শুল্ক ও মাশুল নির্ধারণ।

৩. সেবার মান নিশ্চিতকরণ চুক্তি: পণ্য খালাসের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ ও তা মেনে চলার প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তি।

এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা না গেলে অর্থনৈতিক করিডোরগুলো কেবল মানচিত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর এগুলো বাস্তবায়িত হলে করিডোরগুলো পরিণত হবে সমৃদ্ধ বাজারে।

ট্রানজিট: দায় নয়, শক্তি

প্রতিবেশীদের জন্য আমাদের বন্দর ও ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ একটি বিরাট সম্ভাবনা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল মাশুল, বিনিয়োগ এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবই অর্জন করবে না, বরং আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে—তবে অবশ্যই নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে। এর সূত্রটি সহজ: স্বচ্ছ চুক্তি, নিরীক্ষাযোগ্য তথ্যপ্রবাহ এবং উভয় পক্ষের জন্য সমান আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। আমাদের বন্দর ব্যবহার করে যদি পণ্য নির্ভরযোগ্যভাবে চলাচল করতে পারে, তবে বিনিয়োগকারীরাও সেই পথ অনুসরণ করবে।

জ্বালানি, ডেটা ও সুনীল অর্থনীতি

জ্বালানি নিরাপত্তা: আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তার অন্যতম ভিত্তি। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা মোকাবিলার সেরা উপায় হলো জ্বালানির উৎস বহুমুখী করা। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আরও বেশি জলবিদ্যুৎ আমদানি, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) জন্য স্মার্ট চুক্তি এবং গ্রিড আধুনিকায়ন, যা সিস্টেম লস ও আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি কমাবে। বৃহৎ প্রকল্পের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ ও শক্তি সঞ্চয় ব্যবস্থার মতো উদ্ভাবনী সমাধানও গ্রহণ করতে হবে। নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ একটি কূটনৈতিক সম্পদ, অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

সুনীল অর্থনীতি: মৎস্যসম্পদ ও অফশোর পরিষেবা থেকে শুরু করে সাবমেরিন কেবল ও ডেটা ল্যান্ডিং স্টেশন পর্যন্ত—বঙ্গোপসাগর হতে পারে উন্নয়নের এক নতুন চালিকাশক্তি। তবে এর জন্য সংরক্ষণ ও বাণিজ্যকে একসঙ্গে চলতে হবে। অবৈধ, অপ্রতিবেদিত এবং অনিয়ন্ত্রিত (IUU) মাছ ধরা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা, সংবেদনশীল সামুদ্রিক অঞ্চলের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক মানের লাভজনক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদেশি পুঁজি আকর্ষণ করতে হবে—তবে তা দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে।

ডেটা সুরক্ষা: বঙ্গোপসাগর কেবল জলের নয়, ফাইবার অপটিকেরও এক বিশাল জাল। একাধিক সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং পয়েন্ট, বিকল্প ব্যবস্থা (রিডানডেন্সি) এবং সুস্পষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ প্রোটোকল শুধু তথ্যপ্রযুক্তির বিষয় নয়, এগুলো আধুনিক বাণিজ্য নীতির এক কৌশলগত অনুষঙ্গ। একটি স্থিতিশীল ও নিয়মভিত্তিক ডেটা করিডোর আমাদের পরিষেবা খাতের রপ্তানি বাড়াবে এবং বাংলাদেশকে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরাপদ ডেটা হাবে পরিণত করবে।

ত্রি-মাত্রিক পরীক্ষা: বাস্তবায়ন, তথ্য-উপাত্ত ও কূটনীতি

ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো স্লোগানে ভরপুর একটি অঞ্চলে বিশ্বাসযোগ্যতাই হলো সবচেয়ে বড় মুদ্রা। বাংলাদেশের কূটনীতি হওয়া উচিত ফলাফল-ভিত্তিক। এর জন্য ‘থ্রিডি’ বা ত্রি-মাত্রিক পরীক্ষার ওপর জোর দিতে হবে:

বাস্তবায়ন (Delivery): বন্দরের ডিওয়েল টাইম (জাহাজ অপেক্ষার সময়), ক্লিয়ারেন্স টাইম এবং অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা মহড়ার মতো বিষয়গুলোর ওপর ত্রৈমাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা।
তথ্য-উপাত্ত (Data): ডিজিটাল পোর্ট পাস এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পণ্য ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করা এবং অংশীদারদের সঙ্গে পরিচয় গোপন রেখে পারফরম্যান্স মেট্রিক্স বিনিময় করা।

কূটনীতি (Diplomacy): সফল পাইলট প্রকল্পগুলোকে আঞ্চলিক সমঝোতা স্মারকে (MoC) রূপান্তর করা এবং বড় পরিসরে বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি পুঁজিকে আমন্ত্রণ জানানো।
শেষ পর্যন্ত, এই গতিশীল অঞ্চলে প্রভাব দাবি করে আসে না, কাজের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে শুধু নিয়ম গ্রহণকারী নয়, বরং করিডোরের মান, সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রোটোকল এবং দুর্যোগ মোকাবিলার মতো বিষয়ে নিয়ম প্রণয়নকারী হয়ে ওঠার সক্ষমতা রাখে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল কেবল কর্মবীরদেরই পুরস্কৃত করে। আমাদের এখন যা কাজে লাগে তা তৈরি করতে হবে, যা গুরুত্বপূর্ণ তা পরিমাপ করতে হবে এবং সফল বাস্তবায়নের শক্তিকে পুঁজি করে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে।

মূল নীতিগত সুপারিশ

১. সামুদ্রিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য সহজীকরণ এবং সুনীল অর্থনীতির পাইলট প্রকল্পগুলোর ওপর ভিত্তি করে একটি দুই বছরমেয়াদি ইন্দো-প্যাসিফিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, যেখানে সুস্পষ্ট কর্মক্ষমতা সূচক (KPIs) থাকবে।

২. মেরিটাইম ডোমেইন অ্যাওয়ারনেস (MDA) এবং অনুসন্ধান ও উদ্ধার (SAR) কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরকে নিয়ে একটি ‘বঙ্গোপসাগরীয় সমন্বয় সেল’ গঠন করা।

৩. মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত রেল, সড়ক ও ডিজিটাল সংযোগ নিশ্চিত করতে অর্থায়ন সম্পন্ন করা।

৪. স্বচ্ছ মাশুল নির্ধারণ ও একক ব্যবস্থা (সিঙ্গেল উইন্ডো) চালুর মাধ্যমে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।

৫. আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের ঝুঁকি মোকাবিলার কৌশল ঠিক করে আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য আরও প্রসারিত করা।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।