বঙ্গবন্ধু হত্যার ৫০ বছর

স্টাফ রিপোর্টার : আজ ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এইদিন ভোরে একদল বিপথগামী সেনাসদস্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবনে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
ওই হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারান তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন পুত্র—শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের। এছাড়াও হত্যার শিকার হন কর্নেল জামিল, এসবির কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান ও সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক।
একই রাতে সেনাসদস্যদের আরেকটি দল শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করে। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা করে তাকে ও তার কন্যা বেবি, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় আবদুল নঈম খানকে হত্যা করা হয়।
তখন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় রচনা করে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামকে বিজয়ে রূপান্তর করেন তিনি। তবে স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে নানা চ্যালেঞ্জ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার মধ্যে তাকে একাধিক সংকট মোকাবিলা করতে হয়।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে ১৯৭৫ সালের শুরুতে তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ চালু করেন, যা বিরোধী রাজনৈতিক মহলে তীব্র সমালোচনা ও অসন্তোষের জন্ম দেয়। এ পরিস্থিতিই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা বাড়িয়ে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববাসী তখন হতবাক হয়ে পড়ে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ ঘটনাকে ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অন্ধকারতম দিন’ আখ্যা দিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুগোস্লাভিয়া শোকবার্তা পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদানের প্রশংসা করে এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায়। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল তুলনামূলক সংযত। অনেক গবেষক মনে করেন, শীতলযুদ্ধের সময় দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ও বঙ্গবন্ধুর নীতিনিষ্ঠ পররাষ্ট্র কৌশলই তাকে কিছু আন্তর্জাতিক চক্রের টার্গেটে পরিণত করেছিল।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত ১৫ আগস্ট ঘিরে সারাদেশে পালিত হতো নানান কর্মসূচি। যার মধ্যে ছিল জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত, কালো পতাকা উত্তোলন, কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও চিত্র প্রদর্শনী। সকাল থেকে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল নামতো।
এছাড়া এদিনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সাধারণ জনগণ শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন। টেলিভিশন, বেতার ও সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান ও স্মৃতিচারণ প্রচার করা হতো। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজনে দিনটি পালন করতেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের কন্যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে বদলে যায় প্রেক্ষাপট। ১৫ আগস্ট পালনেও আসে ভিন্নতা। গত এক বছর ধরে আওয়ামী লীগের অনেক অনুসারী ও নেতাকর্মী পলাতক। ঘোষণা দিলেও শোকাবহ কর্মসূচি নেই। ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিলেও আছে বাধা।
পঁচাত্তরের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ও এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে এখন আর সরকারি ছুটি নেই। গত বছর এ ছুটি বাতিল করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
(ওএস/এএস/আগস্ট ১৫, ২০২৫)