শুভ জন্মাষ্টমী

দেবেশ চন্দ্র সান্যাল
"ওঁ নীলোৎপল দল শ্যামং যশোদানন্দ নন্দনম্। গোপিকা নয়নানন্দং গোপালং প্রণমাম্যহম্।" আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথি জন্মাষ্টমী পালন করে থাকি। যখন পাশবিক শক্তি সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়, তখন সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ভক্তের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর অবতার রূপে পৃথিবীতে আসেন।
বিষ্ণুপুরাণ ও অন্যান্য পুরাণের মর্মানুসারে শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনী জানা যায়। দ্বাপর যুগে কংসের অত্যাচারে ধরণী ত্রাসের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। কংসের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য রাজা বৃষধ্বজ মহাদেবের শরণাপন্ন হন। মহাদেব ব্রহ্মাকে সঙ্গে নিয়ে ভগবান বিষ্ণুর কাছে যান। মহাদেব ও ব্রহ্মা বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা জানান, "হে পতিতপাবন নারায়ণ, ধরণীকে কংসের অত্যাচার থেকে রক্ষা করুন। হে নারায়ণ, ভাগিনেয় ছাড়া কেউ কংসকে বধ করতে পারবে না। কৃপা করে আপনি কংসের ভগ্নী দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে কংসাদি দুরাচারের বিনাশ করুন।" সকলের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে স্বয়ং বিষ্ণু ষড়গুণ অর্থাৎ শৌর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্যসম্পন্ন পূর্ণাবতার রূপে শ্রীকৃষ্ণ রূপে প্রকাশিত হন।
শুভ জন্মাষ্টমী হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রযুক্ত রজনীতে শঙ্খচক্র, গদা, পদ্মধারী নারায়ণ মথুরার কারাগারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহণ করেন।
সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, যখনই পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে গিয়ে ধার্মিক ও সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখনই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের রক্ষা এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য পরমেশ্বর ভগবান পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। কংসের বিনাশের কাহিনীটি হলো:
বসুদেব ও দেবকীর বিয়ের পর রাজা কংস তাঁর আদরের ছোট বোন দেবকী এবং তাঁর স্বামী বসুদেবকে রথে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় দৈববাণী হলো, "তোর বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানই হবে তোর (কংসের) মৃত্যুর কারণ।" দৈববাণী শুনে কংস সঙ্গে সঙ্গে দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। তখন বসুদেব তাঁকে এই বলে নিবৃত্ত করলেন, "আমাদের দুজনকে কারাগারে আটকে রাখুন, কিন্তু আপনার বোনকে হত্যা করবেন না। আমাদের সন্তান হলে আমরা আপনার হাতে তুলে দেব। জন্মের পরই আপনি তাদের হত্যা করে নিজের প্রাণ সংশয় দূর করবেন।"
ভগবানের লীলা বাস্তবায়নের জন্য বসুদেবের যুক্তি কংসের মনঃপূত হলো। তিনি তাঁদের কারাবন্দি করলেন। এরপর একে একে ছয়টি সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেন দেবকী ও বসুদেব।পরে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির রাতে দেবকী অষ্টম সন্তানের জন্ম দেন। একই রাতে মা যশোদা যোগমায়ারূপী এক কন্যাকে প্রসব করেন। সেই রাত ছিল ঝড়-ঝঞ্ঝাপূর্ণ। ভগবানের লীলায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে কারাগারের ফটকে প্রহরীরা ঘুমে অচেতন হয়ে ছিল।
কংসের কারাগারে বসুদেব ও দেবকীকে শঙ্ক,চক্র, গদা, পদ্মধারী ধারী ভগবান নারায়ণ রূপে দর্শন দিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দৈববাণী হলো, "বসুদেব, এই মুহূর্তে দেবকীর সদ্যোজাত পুত্রকে নন্দালয়ে যশোদার কোলে রেখে তার সদ্যোজাত কন্যাকে দেবকীর কোলে এনে রাখো।" এ সময় কারাগারের দরজাও খুলে গেল। বসুদেব ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছেলেকে নিয়ে গোকুলে যশোদার পাশে রেখে এলেন এবং যশোদার সদ্যোজাত কন্যাকে নিয়ে এলেন।
শ্রী কৃষ্ণ কে বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য বসুদেবের অলক্ষে নাগ ফণা বিস্তার করে চললেন। শ্রী কৃষ্ণের অঙ্গ জ্যোতি সূর্যের মত। ভগবান শ্রী কৃষ্ণের অঙ্গ জ্যোতির আলো ও বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে বসুদেব পথ চলছেন মথুরা থেকে বৃন্দাবনে যেতে সামনে পড়লো অকুল যমুনা নদী। যমুনার উত্তাল তরঙ্গ মালা ভয়ার রূপ ধারণ করেছে।
তিনি ভীত মনে এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। ক্রমে ক্রমে যমুনার তীরে এলেন। ভাবছেন- কিভাবে শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে যমুনা নদী পার হবেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন- এক শৃগাল হেঁটে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। যোগমায়ার প্রভাবে মায়া মুগ্ধ বসুদের সেই শৃগালকে অনুসরণ করে পথ চলতে লাগলেন।
এদিকে যমুনা দেবী শ্রী কৃষ্ণ চরণ পাবার জন্য আকুল প্রার্থনা করছেন। ভক্ত বাঞ্ছাপূরণে শিশু-কৃষ্ণ ছল করে জল কেলি করার জন্য জলে পরে গেলেন। ইহার পর শ্রী কৃষ্ণ যমুনা নদীর মনো বাসনা পূর্ণ করে দেখে উঠলেন। শ্রীকৃষ্ণকে পেয়ে বসুদেব আনন্দিত। তাঁকে নিয়ে দ্রুত গতিতে যমুনা পার হয়ে নন্দালয়ে প্রবেশ করলেন।
যোগমায়ার যোগসামর্থ্যের প্রভাবে দ্বার ও দরজাও খুলে গেল। নন্দালয়ে প্রবেশ করে নন্দালয়ের সিংহদ্বার দিয়ে বসুদেব দেখতে পেলেন – যশোদা রাণী ঘুমে অচেতন, আর তার পাশে কন্যারূপী এক শিশু আলো করে আছে। তৎক্ষণাৎ বসুদেব কৃষ্ণকে যশোদার পাশে রেখে কন্যারূপী সাক্ষাৎ শিশুকে কোলে নিয়ে দ্রুত গতিতে কংসের কারাগার মথুরায় ফিরে এলেন। যোগমায়ারূপী কন্যা শিশুকে দেবকীর কোলে দিলেন। কন্যাকে পেয়ে বসুদেব বারবার মুখ চুম্বন করে বক্ষে ধারণ করলেন। কন্যারূপী মহামায়ার অঙ্গজ্যোতিতে যোগমায়ার প্রভাবে দেবকী পুণ্য ও শুদ্ধ সুবাসে আপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং কারাকপাটও পুনরায় তালাবদ্ধ হয়ে গেল। রাত্রি প্রভাত; কারণ রক্ষীরা জেগে উঠল, ভিতরে শিশুকন্যার কান্নার শব্দে।
পরদিন সকালে কংস এলে তিনি সেই কন্যাকে কংসের হাতে তুলে দেন। পরদিন সকালে তপ্ত কাঞ্চন বর্ণা ও পূর্ণেন্দুর মতো মুখশ্রীযুক্তা সেই কন্যাকে দেখে কংস ভীত হয়ে আদেশ দিলেন, "বধ করো এই কন্যাকে।" পাথরের ওপর আছড়ে মারতেই যোগমায়া ঊর্ধ্বে উঠে বললেন, "হে পামর, তোমাকে বধ করবে যে, সে গোকুলে বড় হচ্ছে।"
পরে গোকুলেই বড় হতে থাকেন শ্রীকৃষ্ণ। পরবর্তীকালে দ্বারকার রাজা হয়ে তিনি যুদ্ধে মথুরারাজ কংসকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপ শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণু অবতার, আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এটি বিশ্বাস করি। জন্মাষ্টমীতে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করলে জগতের সব সুখ লাভ হয়। পরিবার, দেশ ও সমাজের মঙ্গল হয়। তাই শুধু মথুরা নয়, শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবন থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই এই তিথিটি ভক্তিভরে পালন করে থাকেন। আমরা জানি, এই দিনে ব্রত পালন করলে মনের ময়লা দূর হয়, সৎ গুণের জয় হয় এবং এর ফলস্বরূপ মৃত্যুর পর জীবাত্মার মুক্তি হয়। আমাদের বাংলাদেশে শ্রী শ্রী জন্মাষ্টমী উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে।
নিজের জন্ম সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "আমার জন্ম-মৃত্যু সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়, কিন্তু আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া এবং অন্তর্হিত হওয়া— দুটিই আমার অলৌকিক লীলা।"
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, "আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর হয়েও নিজ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।"যিনি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, তিনিই ভগবান। বেদে তার পরিচয় ব্রহ্ম। আমাদের ষড়েন্দ্রিয়, আমাদের ক্ষুদ্র মন, আমাদের সংকীর্ণ বুদ্ধি— এসবের বহু ঊর্ধ্বে তিনি। তাঁকে পাওয়া আমাদের সাধ্যের বাইরে, তবে তাঁকে পাওয়ার জন্য ভক্তের নিরন্তর আকুলতা সৃষ্টিকর্তার মনেও দোলা না দিয়ে পারে না। এ সমস্যার সমাধান করলেন তিনি নিজেই নিত্য ও অনুগ্রহ শক্তির প্রেরণায়।
গীতার ৭/১০ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, "হে পার্থ, আমাকে সর্বভূতের সনাতন বীজ বলে জানিও। আমি বুদ্ধিমানদের বুদ্ধি এবং তেজস্বীগণের তেজস্বরূপ।" ৪/১১ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "যে যে ভাবে আমার আরাধনা করে, আমি সেইভাবে তাকে কৃপা করি।"
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা।