চৌধুরী আবদুল হান্নান


“জামিনের শর্ত হিসেবে প্রাথমিকভাবে খেলাপি ঋণের একটি উল্লেখযোগ‍্য অংশ জমা দেবেন এবং প্রতিমাসে বা ত্রৈমাসিকে টাকা জমা দেওয়ার একটি লিখিত পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। প্রাথমিক জমা দিয়ে আদালতে জামিন আবেদন করবেন।”

কারাবন্দী এক আসামির এমন আকুতি আজকের শিরোনাম।অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং মামলায় আদালতে জামিন আবেদনের শুনানিতে নাসা গ্রুপের কর্ণধার ও এক্সিম ব‍্যাংকের সাবেক চেয়ারম‍্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এসব কথা বলেন।

ব‍্যাংক উদ‍্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ‍্যাসোসিয়েশন অব ব‍্যাংকারস (বিএবি) এর সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি ১৫ বছর এবং সে কারণে ব‍্যাংক ও আর্থিক খাত তার একচেটিয়া দাপট প্রত‍্যক্ষ করেছে। সরকার পতনের পর পদ হারিয়ে তিনি এখন কারগারে আটক কয়েদী।

ব‍্যাংক থেকে অবাধে টাকা বের করে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকের নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে, এ জন‍্য মূলত সর্বশেষ তিন গভর্নরকে দায়ী করা হয়। সুযোগ বুঝে যিনি “বস্তা ভরে” টাকা নিয়ে গেছেন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিন্ত যারা সুযোগ করে দিয়েছেন তাদের গায়ে আজও কোনো আঁচড় লাগেনি। ব‍্যাংক থেকে যারা টাকা নিয়ে গেছেন তারা কারাগারে যাবেন আর যারা টাকার বাক্স খুলে দিলেন তারা কী করে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন?

জনাব নজরুল প্রায় ১৮ বছর এক্সিম ব‍্যাংকের চেয়ারম‍্যানের দায়িত্বে ছিলেন, এ দীর্ঘ সময় ধরে সীমাহীন অব‍্যস্থাপনা আর অর্থ লুটের ঘটনা ঘটেছে এবং ব‍্যাংকটি এখন অস্তিত্ব সংকটে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব‍্যাংক এশিয়ার দায়েরকৃত মামলায় সম্প্রতি একটি অর্থঋণ আদালত এক্সিম ব‍্যাংকের প্রধান কার্যালয় ক্রোক করার আদেশ দিয়েছেন। তারল‍্য সংকট মোকাবিলায় জরুরি প্রয়োজনে নেওয়া ঋণ ফেরত দিতে ব‍্যর্থ হওয়া আর কতটা দেউলিয়ার পথে গেলে একটি ব‍্যাংকের প্রধান কার্যালয় ক্রোক করার মতো অবস্থা তৈরি হয়।

বাংলাদেশ ব‍্যাংকের গভর্নর বলেন, “পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার এবং ভবিষ‍্যতে অর্থ পাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের জীবন কঠিন করে ফেলা হবে।” কিন্ত ইতোমধ‍্যে আর্থিক খাতের ওই সকল দুর্বৃত্তরা আমাদের জীবনই কঠিন করে দিয়েছে। দেশের অর্থ ভান্ডার খালি, মূল‍্যস্ফীতি চরমে, দেশের নাগরিকদের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। সরকার এখন অর্থপাচারকারীদের সাথে আপসরফা বা সমঝোতার কথা ভাবছে।

কোনো কালে পৃথিবীর কোনো দেশে অর্থনীতির মেরুদন্ড আর্থিক খাতের এমন করুণ দশা কি হয়েছে ? এখন পাচারকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ! তবে পরিস্থিতি ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় সব কিছু করা যায়। কথায় আছে, সর্বনাশের মুখে অর্ধেক পরিত‍্যাগ করা বিচক্ষণতার পরিচায়ক। কিছু অর্থ ফিরে আসুক, যা আসে তাই লাভ!

টাকা উদ্ধারে আপসরফার উদ‍্যোগ নিতে হবে কেস টু কেস ভিত্তিতে সফলতা প্রাপ্তির সম্ভাবনা বিবেচনায়। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেপ্তার নজরুল ইসলাম মজুমদারের সাথে বর্তমান পরিস্থিতিতে সমঝোতার কথা ভাবা না গেলেও শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে।

জামিনের শর্ত হিসেবে প্রাথমিকভাবে খেলাপি ঋণের একটি উল্লেখযোগ‍্য অংশ জমা দেবেন এবং প্রতিমাসে বা প্রতি ত্রৈমাসিকে টাকা জমা দেওয়ার একটি লিখিত পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। প্রাথমিক জমা দিয়ে আদালতে জামিন আবেদন করবেন। এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকবেন মামলার বাদী ও বিবাদীর প্রতিনিধিরা যাতে আদালতের নিকট গ্রহণযোগ‍্য প্রস্তাব পেশ করা যায়। তাছাড়া ব‍্যবসায়ীদের অনেকেই মনে করেন শিল্প মালিকদের দীর্ঘদিন আটক রাখলে ব‍্যবসা বাণিজ‍্যেরই ক্ষতি। মালিকের অনুপস্থিতিতে ব‍্যবসা চলমান রাখা কঠিন এবং তাতে কর্মচারীগণ কাজ হারায়।

তাছাড়া ব‍্যাংকের অর্থঋণ আদালতের মামলায় অনেক ক্ষেত্রে আদালতের বাইরে আলোচনার মাধ‍্যমে খেলাপি ঋণ আদায় এবং মামলা নিষ্পত্তির প্রচলন রয়েছে। এ ধরনের উদ‍্যোগ তো এক প্রকার আপসরফা বা সমঝোতা বলা যায় যা সরকারের বর্তমান ভাবনার অংশ।

অপরাধের বিচার আদালত করবেন, কিন্ত ঋণের অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টা তো থেমে থাকতে পারে না।আইন আদালত করে অর্থ উদ্ধার করা সহজ নয়। বর্তমান বিচার ব‍্যবস্থায় আর্থিক খাত কখনেই ঘুরে দাঁড়াবে না- রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন না হলে তদারকি ব‍্যবস্হাও ব‍্যাংকের ঝুঁকি কমাতে পারবে না — এমন মন্তব‍্য কেন্দ্রীয় ব‍্যাংকের গভর্নরের।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব‍্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর রাজনৈতিক ব‍্যক্তি নন, তাঁরা আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞ। তাঁরা দু’জন যতদিন আর্থিক খাতের দায়িত্বে আছেন, ততদিন এ খাতের সংস্কার কাজ সঠিকভাবে এবং নির্বিঘ্নে করতে সক্ষম হবেন — এ বিশ্বাস আমাদের রয়েছে।

অর্থ পাচারকারী বা আত্মসাতকারীকে কারাগারে আটক রাখার চেয়ে টাকা উদ্ধারে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। একটি টেষ্ট কেস হিসেবে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে পাচারকৃত/অবৈধভাবে নেওয়া অর্থ উদ্ধারের লক্ষ‍্যে শর্ত সাপেক্ষে জামিনের উদ‍্যোগ নেওয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। তাতে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে কিন্ত এর মধ‍্যেই সঠিক কাজটা করতে হবে এবং সৎ ও সাহসী লোকেরাই তা পারেন। এ উদ‍্যোগ সফল হলে পর্যায়ক্রমে অন‍্যান‍্যদের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করা যাবে।

আর্থিক খাত অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব‍্য করেছেন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা, সেক্ষেত্রে আমাদের অনুরূপ উদ‍্যোগ অব‍্যাহত থাকলে একদা ডুবে যাওয়া ব‍্যাংক ও আর্থিক খাত ঠিকই পুরোপুরি চাঙা হয়ে উঠবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব‍্যাংক।