দেশবিরোধী অপশক্তি ও বিদেশি এজেন্টমুক্ত বাংলাদেশ চাই

আবীর আহাদ
বঙ্গবন্ধুর নামে ও নেতৃত্বে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য্য ও বীরত্ত্বে এবং বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষায়। স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, সাম্যভিত্তিক, মানবিক মর্যাদা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের উত্তরসূরি, অগণতান্ত্রিক লুটেরা চক্র এবং বিদেশী এজেন্টদের প্রভাব জাতিকে অশান্ত করছে।
কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভেতর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও বিদেশী এজেন্টদের স্থান থাকতে পারে না। গণতন্ত্রে ভিন্ন দল ও ভিন্ন মত থাকতেই পারে, সেটাই রাজনৈতিক সৌন্দর্যের প্রতীক। কিন্তু দেশবিরোধী রাজাকারচক্র ও বিদেশী এজেন্টদের মাধ্যমে যখন রাষ্ট্রবিরোধিতা, ইতিহাস বিকৃতি, বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ এবং জাতীয়তাবাদবিরোধী কার্যকলাপ ঘটে, তখন সেটি সরাসরি স্বাধীনতার চেতনার প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সময় এসেছে স্পষ্টভাবে বলার: দেশবিরোধী অপশক্তি ও বিদেশী এজেন্টমুক্ত বাংলাদেশ চাই।
দেশবিরোধী অপশক্তি
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও আলমুজাহিদরা গ্রামে গ্রামে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধর্ষণের ভয়াবহতা চালায়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সরকার Collaborators Order, 1972 প্রণয়ন করে বিচারের উদ্যোগ নেয়, কিন্তু রাজনৈতিক আপস ও সীমাবদ্ধতায় বহু অপরাধী শাস্তি এড়িয়ে যায়। পরবর্তীকালে তারা ছদ্মবেশে সমাজ ও রাজনীতিতে প্রবেশ করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে, কিন্তু এখনও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় থেকে ইতিহাস বিকৃত করছে ও তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে।
বিদেশি এজেন্ট প্রশ্ন
ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ সবসময়ই বিশ্বশক্তির টানাপোড়েনে থেকেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই মার্কিন CIA, পাকিস্তানি ISI, সোভিয়েত KGB প্রভৃতি গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয় ছিল। আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, চীনের Belt and Road Initiative ও ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা নীতি—সবকিছুই বাংলাদেশের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
কিন্তু বিদেশী প্রভাব এখন আর গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; প্রকাশ্যভাবেও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ও তথাকথিত ‘জাতীয় ঐকমত্য সংস্কার কমিশনে’ বিদেশী নাগরিকদের উপস্থিতি জাতীয় অঙ্গনে প্রশ্ন তুলেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন খবরও এসেছে যে, মার্কিন স্বার্থে সেন্টমার্টিন দ্বীপ, মায়ানমার করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারযোগ্য করে দেয়ার উদ্যোগ চলছে। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, বিদেশী এজেন্টদের কার্যকলাপ আমাদের সার্বভৌমত্বকে আজও হুমকির মুখে ফেলছে।
সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশের সংবিধান (অনুচ্ছেদ ৭ ও ৮) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে: জনগণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক এবং জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। সুতরাং রাজাকার অপশক্তি বা বিদেশী এজেন্টদের কার্যকলাপ সরাসরি অসাংবিধানিক ও রাষ্ট্রদ্রোহী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আংশিক সফল হলেও এখন জরুরি হচ্ছে বিদেশী এজেন্ট নেটওয়ার্ক মোকাবিলা করা এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা।
করণীয়
১. রাজাকার অপশক্তিমুক্ত বাংলাদেশ
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল ও ব্যক্তির রাজনৈতিক অংশগ্রহণ রোধ করা।
পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করা।
২. বিদেশী এজেন্টমুক্ত বাংলাদেশ
গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে বিদেশী নেটওয়ার্ক শনাক্ত ও দমন করা।
উপদেষ্টা পরিষদ, সংস্কার কমিশন ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বিদেশী নাগরিকের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা।
রাজনৈতিক অর্থায়ন ও মিডিয়ায় বিদেশী প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা।
অর্থনীতি ও কূটনীতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা।
স্বাধীনতা অর্জন একবারের ঘটনা, কিন্তু স্বাধীনতাকে রক্ষা করা চলমান সংগ্রাম। রাজাকাররা যেমন অতীতে আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তেমনি বিদেশী এজেন্টরা আজ আমাদের সার্বভৌমত্বকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার পূর্ণতা পেতে হলে জাতিকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধভাবে ঘোষণা করতে হবে: দেশবিরোধী রাজাকারচক্র ও বিদেশী এজেন্টমুক্ত বাংলাদেশ চাই।
লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।