কয়লা সংকটে উৎপাদন বন্ধ ৩০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎকেন্দ্রে

স্টাফ রিপোর্টার : কয়লা সংকটে পটুয়াখালীর কয়লাভিত্তিক বৃহৎ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। মাসের পর মাস উৎপাদন না করে শুধু দেওয়া হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। গচ্চা যাচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা।
কিন্তু কয়লা আমদানিতে সরকারের অনীহা। কয়লা আমদানির জন্য বারবার দরপত্রের সুপারিশ করা হলেও তা অদৃশ্য কারণে বাতিল হচ্ছে। এমন অবস্থায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু রাখতে কয়লা আমদানি করার অনুমোদন দেওয়া জরুরি বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর নির্ধারিত সময় পার হলেও পুরোনো সিন্ডিকেটের বাধায় কয়লার সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না আরপিসিএল-নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড (আনএনপিএল) কর্তৃপক্ষ। সবশেষ চতুর্থ দফা দরপত্র বাতিল করে পুনরায় আহ্বানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে নতুন করে অনিশ্চয়তায় পড়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
বিদ্যুৎবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আরএনপিএলের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। দুটি ইউনিট প্রস্তুত হলেও কয়লার কোম্পানি নির্বাচন করতে না পারায় পূর্ণ সক্ষমতায় কেন্দ্রটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে সরকার। কারণ মোট ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার চীনের ঋণ রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন দফায় দফায় পেছানো হচ্ছে। অথচ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর আগেই বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এ কেন্দ্র ব্যবহার না করলেও সরকারকে বড় আকারের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে।
বিদ্যুৎবিভাগের তথ্যমতে, চতুর্থ দফার চূড়ান্ত পর্যায়ে দরপত্রে ত্রুটি ও অনিয়ম অভিযোগে তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি দরপত্র বাতিল করে দ্রুত নতুন দরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করে। ভবিষ্যতে কয়লা ক্রয়ে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন, বিশেষ করে কয়লার ক্যালোরিফিক ভেল্যু (জিএআর), অ্যাশ ফিউশন টেম্পারেচার, কয়লার সাইজ দরপত্রে শর্তে এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে; যেন দরপত্র প্রক্রিয়ায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক সুপারিশ করা হয়। আগামীতে কয়লা ক্রয়ের চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে দুই বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আরএনপিএলের দরপত্র অনুযায়ী, শর্তপূরণ করে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি যোগ্য বিবেচিত হলেও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর চাপে তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর আগেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে দফায় দফায় শর্ত শিথিল করা হয়েছিল। এরপরও সিন্ডিকেটের পছন্দের কোম্পানি না আসায় শর্ত শিথিলের কথা বলা হচ্ছে। যদিও সর্বশেষ মূল্যায়ন আর্থিক প্রতিবেদনে ইয়াংথাই এনার্জি প্রস্তাবিত দরকে সাশ্রয়ী বলে গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছিল।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নথিপত্রের ঘেটে দেখা যায়, কয়লার মান ও অ্যাশ ফিউশন আরও কমানো হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডিজাইন অনুযায়ী বয়লার তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার কিলোক্যালরি কম হলে তাতে জ্বালানি ব্যয় বেশি হওয়ার বড় আশঙ্কা রয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে। কেন্দ্রটি থেকে প্রতিমাসে সাড়ে ১০ মিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে অন্তত সাড়ে ৭ মিলিয়ন ডলারের (জ্বালানি খরচ বাদে) বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রের আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে।
আরএনপিএল সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের জন্য ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রথমবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে বেশ কয়েকটি কোম্পানি শিডিউল কেনে। সাতটি কোম্পানিকে শর্ট লিস্টও করা হয়। পরবর্তীতে দরপত্রে বেশকিছু শর্ত পরিবর্তনের কারণে তা বাতিল করা হয়। ওই দরপত্রে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড শিডিউল কেনে। কিন্তু পরবর্তীতে দরপত্রটি বাতিল হয়ে যায়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য দীর্ঘমেয়াদে কয়লা আমদানি চুক্তির জন্য গত বছরের ১৫ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। পাঁচটি কোম্পানি দরপত্র জমা দেয়। ওই বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি দরপত্র খোলার সময়সীমা ছিল। দরপত্রে ইয়ংথাই কারিগরিভাবে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই দরপত্র পরে বাতিল হয়ে যায়।
অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর আরএনপিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা আমদানির জন্য ৬ নভেম্বর তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করে। ওই দরপত্র আহ্বানের পর দেশি-বিদেশি অন্তত ২৫টি কোম্পানি অংশ নেয়। ওই দরপত্রে কোম্পানির আর্থিক যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কয়লাখনি, কয়লার মানসংক্রান্ত শর্ত নিয়ে আরএনপিএলের রিভিউ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেবারও কয়লা আমদানির দরপত্রে শর্তের সবকিছু পূরণ করে কাগজপত্র জমা দেয় সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি।
কিন্তু অন্যান্য কোম্পানি দরপত্রের চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র জমা দিতে না পারায় টেন্ডার থেকে ছিটকে পড়ে। এ দফায় বাদ পড়া বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে দরপত্রের কঠিন শর্ত শিথিলের অনুরাধ জানায়। বিষয়টি বিবেচনা করে কয়েক দফা শর্ত শিথিল করার পাশাপাশি সময়ও বাড়ানো হয়। এরপরও বাকিরা দরপত্র দাখিল করেনি।
ফলে ইয়াংথাই এনার্জি একক দরদাতা হয়। চতুর্থ দফায় দরপত্রে ইয়াংথাই কারিগরিভাবে যোগ্য নির্বাচিত হলেও আর্থিক ত্রুটি ও অনিয়ম দেখিয়ে দরপত্র বাতিলের সুপারিশ করা হয়।
ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে এমনিতেই বছরের পর বছর আমাদের একটা বড় অংকের অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছে। পটুয়াখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সক্ষমতার দিকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। শুধু কয়লার অভাবে উৎপাদন করতে না পারাটা মানা যাচ্ছে না। অন্তবর্তী সরকার এখন অনেক কাজ করছে। আশা করছি, এ কেন্দ্রটি নিয়েও কাজ করবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ এটি নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি, খুব শিগগির এ কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে পারবে। এক্ষেত্রে কয়লার দরপত্রের জন্য যা যা করণীয়, তা করা হবে।
(ওএস/এএস/আগস্ট ১৯, ২০২৫)