আবীর আহাদ


বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাই সর্বজনবিদিত। তাঁর একেকটি নির্দেশনা, একেকটি অঙ্গভঙ্গিই বাঙালির জাতীয় ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। তাই যথার্থই বলা যায়:বঙ্গবন্ধুর এক অঙ্গুলি নির্দেশেই বাংলাদেশ দু’বার স্বাধীন হয়েছে।

প্রথম স্বাধীনতা : ৭ মার্চ = ২৬ মার্চ ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো লাখো মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ডানহাতের তর্জনী উঁচিয়ে ঘোষণা করেছিলেন:

“তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে! এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা!”

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে বাঙালি জাতির ওপর নৃশংস গণহত্যা চালায়। এর প্রতিবাদে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। তিনি ওয়ারলেসে বলেন: ''এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন- জয়বাংলা!"' এ ঘোষণা হানাদারদের গোচরিভূত হতেই তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ।

তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক আহ্বানে সমগ্র জাতি জেগে উঠেছিল। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার পর লক্ষাধিক যুবক মুক্তির শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্বের অন্যতম মহাশক্তি সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মদদপুষ্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও আলমুজাহিদ বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বিজয়ের পর বাংলাদেশে প্রায় এক লক্ষ ভারতীয় সেনা অবস্থান করছিল।

দ্বিতীয় স্বাধীনতা : ১০ জানুয়ারি ১৯৭২

স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফেরার পথে দিল্লীতে নামেন। সামরিক গার্ড অব অনার শেষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় তিনি অকপটে প্রশ্ন রাখেন:

“কবে আপনি বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করবেন?”

বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত উচ্চারণে মুহূর্তের জন্য বিস্মিত হলেও ইন্দিরা গান্ধী পরক্ষণে মৃদুহাস্যে জবাব দেন: “আপ যব চাহিঙ্গে!” এবং যোগ করেন: “১৭ মার্চ আপনার জন্মদিনের আগেই আমার বাহিনী বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারিত হবে।”

ঠিকই দেখা গেলো, ১২ মার্চ মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল জগৎসিং অরোরা আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে ‘লাস্ট স্যালুট’ জানিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন। আর বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন, ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী শুভেচ্ছাসফরে বাংলাদেশে আসেন।

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মুখের ওপর বঙ্গবন্ধুর সেই দৃপ্ত উচ্চারণে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিদেশী সেনার ছত্রছায়ায় নয়, বরং বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের ফসল। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই মাত্র আড়াই মাসের মাথায় ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশ ত্যাগ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিজয়ী সেনাবাহিনী এত দ্রুত কোনো মুক্ত দেশ থেকে সরে যাওয়ার নজির প্রায় নেই। এটা সম্ভব হয়েছিলো ইন্দিরা গান্ধীর আন্তর্জাতিক মানবিক নেতৃত্ব ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনচেতা দৃঢ়তার কারণে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে যেমন বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, তেমনি ১০ জানুয়ারির ঘোষণা বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থেই সার্বভৌম মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করে। ইতিহাসের বিচারে তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়: বঙ্গবন্ধুর এক অঙ্গুলি নির্দেশেই বাংলাদেশ দু’বার স্বাধীন হয়েছে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।