আবীর আহাদ


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস নয়—এটি জাতির আত্মপরিচয়, অস্তিত্ব ও মুক্তির লড়াইয়ের অনন্য দলিল। সেই ইতিহাসকে অস্বীকার করা বা বিকৃত করার মানে হচ্ছে পুরো জাতির চেতনাকে অপমান করা। এই দিক থেকে বদরুদ্দীন উমর নামধারী তথাকথিত লেখক ও চিন্তাবিদের ভূমিকাকে অনস্বীকার্যভাবে প্রশ্নবিদ্ধ বলা যায়।

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির সর্বজনীন সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ জাতি অস্তিত্বের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ বদরুদ্দীন উমর তাঁর বই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও পরবর্তী রাজনীতি (১৯৮৬)–তে মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের নিজস্ব সংগ্রাম হিসেবে না দেখে কেবল ভারতীয় কূটকৌশলের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত “ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনে সৃষ্টি এক যুদ্ধ”, যেখানে বঙ্গবন্ধু ছিলেন “ভারতের হাতিয়ার”। "২৫ মার্চ শেখ মুজিব পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।" "মুক্তিযুদ্ধে মুজিবের কোনো অবদান নেই"! ইদানিং এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুকে হেয় করে চলেছেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে, নির্দেশনা ও নামে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। প্রকারান্তরে বদরুদ্দীন উমর তার মতো মুক্তিযুদ্ধকালীন বঙ্গবন্ধুকেও একজন পাকিস্তানি সাজাবার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছেন!

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম প্রধান সংগঠক ও প্রেরণাদাতা। কারাগারে থেকেও তিনি আন্দোলনের রণকৌশল নির্ধারণ করেছেন, ভাষাসংগ্রামী ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রেখেছেন। কিন্তু বদরুদ্দীন উমর তাঁর গ্রন্থ পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি–তে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা প্রায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। বরং তিনি পরোক্ষভাবে সরদার জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতাদের ভূমিকা বাড়িয়ে দেখানোর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার অপচেষ্টা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি বিকৃতসুখ অর্জন করেছেন—যা তাঁর মানসিক গোঁড়ামি ও পরশ্রীকাতরতার প্রমাণ।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষ

বাঙালি জাতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল রাষ্ট্রনির্মাতা নন, তিনিই জাতির জনক। তাঁর নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। অথচ বদরুদ্দীন উমরের কলম থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রশংসার বদলে সর্বদা বিদ্বেষ ঝরেছে। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে সর্বদাই নেতিবাচক। স্পষ্টতই দেখা যায়, তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিবিরের মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেননি।

বামপন্থার ছদ্মবেশ

অনেকেই তাঁকে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বলে আখ্যা দেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁর চিন্তা ও কর্ম ছিল বামপন্থার ছদ্মবেশে জাতীয়তাবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ভূমিকা না রেখে তিনি নানা তাত্ত্বিক কচকচির আড়ালে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার বিরুদ্ধেই অবস্থান নেন।

আবুল হাশিমের বঙ্গবন্ধুপ্রেম ও পুত্রের পরশ্রীকাতরতা

এখানে একটি ঐতিহাসিক সত্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম ছিলেন তৎকালীন মুসলিম লীগের অন্যতম অগ্রণী নেতা, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর অনুরাগী। বঙ্গবন্ধুও তাঁকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে আবুল হাশিম প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুত্র বদরুদ্দীন উমর সেই মহান পিতার রাজনৈতিক ঐতিহ্য ধারণ করতে পারেননি। বরং পিতার শ্রদ্ধাভাজন শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক কীর্তি ও জনপ্রিয়তায় তিনি অন্তর্গত হীনমন্যতা ও পরশ্রীকাতরতায় ভুগেছেন। ইতিহাসবিদদের মতে, এই মনস্তাত্ত্বিক কারণও তাঁকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্বেষপরায়ণ করে তুলেছিল। ফলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনবিরোধী ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নিজেকে 'বিপরীতধর্মী' প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।

বিভ্রান্ত ও বিকৃত মানসিকতা

বদরুদ্দীন উমরের কলমে ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, একপেশে ও বিকৃত। তিনি ইতিহাসের সত্যকে আড়াল করে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের মহত্ত্বকে খাটো করার চেষ্টা করেছেন। একারণেই তাঁকে জ্ঞানপাপী বলাই যুক্তিযুক্ত—কারণ জেনেশুনেই তিনি সত্যের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ—এসব সত্যকে অস্বীকার করার যে কোনো প্রয়াসই জাতির অস্তিত্ববিরোধী। বদরুদ্দীন উমর সেই অপচেষ্টার অন্যতম মুখপাত্র। তাই তাঁকে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী নয়, বরং ইতিহাসের এক বিভ্রান্ত, বিকৃত ও বিপথগামী চরিত্র হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।