বিভূরঞ্জন সরকার: সততার মৃত্যু ও আমাদের দায়

মীর আব্দুল আলীম
সাংবাদিক বিভূরঞ্জন সরকার। আমাদের সবার প্রিয় বিভুদা আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তার মৃত্যুর সংবাদ কেবল একজন মানুষের চলে যাওয়া নয়; এটি সততা, সৎ সাংবাদিকতা আর সত্যনিষ্ঠ জীবনের ওপর এক নির্মম আঘাত। ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘ তিন দশকের সম্পর্কের আলোকে, তার জীবনের অভিজ্ঞতা আর মৃত্যুর শোক আজ নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে-এই সমাজে সত্যের কি কোনো দাম আছে? সত্যের জন্য কলম ধরা মানুষগুলো একে একে কেন নিঃশব্দে বিদায় নিচ্ছেন? আর আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা কি কেবল হাহাকার করেই থেমে থাকব, নাকি সত্যিকারের পরিবর্তনের পথ খুঁজব?
আমার সঙ্গে বিভুদার সম্পর্ক প্রায় তিন দশকের। প্রথম দিকে সম্পর্কটা ছিল কেবল সাংবাদিক-সহকর্মীসুলভ। তবে চলতি পত্র অফিস রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে সম্পর্কটা যেন আরেক স্তরে পৌঁছায়। অফিসের পাশেই ছিল আমার বাসা। ফলে তাঁর সাথে প্রায়ই দেখা হতো। অফিসের কাজ শেষ করে তিনি হাঁটতে হাঁটতে আমার বাসায় আসতেন। আমি চায়ের দাওয়াত দিতাম। নিজের হাতে তৈরি করা লিকার দুধ-চা তাঁর খুব পছন্দ ছিল। চায়ের টেবিলে গল্প হতো, আড্ডা জমে উঠত। মাঝেমধ্যে তিনি বলতেন-“আপনার হাতের চায়ের স্বাদ আলাদা।” সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো আজ মনে হলে বুক হাহাকার করে ওঠে। আমরা বুঝিনি সেই হাসি-আড্ডার আড়ালে কী গভীর বেদনা লুকানো ছিল।
বিভুদার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে। সচিবের রুমে কফির টেবিলে আমাদের আলাপচারিতা শুরু হয়েছিল সাধারণ কথোপকথনের মধ্য দিয়ে, কিন্তু কথাগুলো দ্রুত গভীর ও ব্যক্তিগত আঙ্গিকের দিকে প্রবাহিত হয়। বিভুদা তখনো প্রাণবন্ত ছিলেন, চিরচেনা হাসি যেন তার ব্যক্তিত্বের অঙ্গ, যে হাসি মানুষের মন জয় করতে পারে। তিনি ছেলে-মেয়েদের কথা বলছিলেন, এবং সেই সময় তার চোখে একটি অদম্য গর্বের ঝলক ফুটছিল। বারবার তিনি বলতেন, “ওরা অনেক মেধাবী, অনেক দূর যাবে,”-শব্দগুলোতে শুধু গর্ব নয়, ছিল স্বপ্নের দীপ্তি, সন্তানের ভবিষ্যৎকে নিয়ে দিশার আলো। কথা বলার সময় তার চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়া আনন্দে যেন একটি জীবন্ত গল্প লুকিয়ে ছিল। কিন্তু সেই আনন্দের আড়ালে, চোখের আভায় ভেতরটা ছিল কিছুটা চাপা যন্ত্রণা। জীবন যুদ্ধে তার নানা অভাব, আর্থিক অনটন, কর্মহীনতার তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং অসহায় পরিস্থিতির চাপ—সবকিছু তিনি নিজের ভেতরে জমিয়ে রাখতেন। মনে হতো, যেন যদি দুঃখ প্রকাশ করেন, তাহলে অন্যরা কষ্ট পাবে, তাই তা প্রকাশ না করে নিজ ভেতরে চাপা রাখতেন। বিভুদা ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি নিজের ব্যথা নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখতেন, কিন্তু অন্যকে দুঃখ দিতে কখনো চাইতেন না। তার এই বৈশিষ্ট্যই তাকে বিশেষ করে তুলত-একদিকে আন্তরিক আনন্দের প্রতিফলন, অন্যদিকে নিঃশব্দ কষ্টের ভার।
আজকের পত্রিকাতে যোগদানের আগে তিনি দীর্ঘ সময় বেকার ছিলেন। সাংবাদিকতা জীবনের শুরু থেকেই তিনি সক্রিয় ছিলেন, কলমের শক্তি দিয়ে সত্যকে প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে যাওয়া-এই অভিজ্ঞতা যে কত বড় আঘাত হতে পারে, তা বোঝা কঠিন। একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক, যার হাতে ছিল কলমের জোর, যিনি সমাজের চোখে অপরাধ ও অন্যায় চিহ্নিত করেছেন, তাকে জীবনের এক পর্যায়ে বেকারত্বের শিকার হতে দেখলে সমাজের মূল্যবোধ এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রশ্ন উঠে আসে। বিভুদা তার কষ্ট কারো কাছে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেননি; তার মুখে কথা ছিল স্বাভাবিক, চোখে হাসি, কিন্তু তার নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস, একরাশ মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা, অনেক কিছুই প্রকাশ করত। সমাজ যেভাবে একজন সৎ সাংবাদিককে একাকী করে ফেলে দিতে পারে, বিভুদা ছিলেন তার জীবন্ত প্রমাণ। তার একাকিত্ব শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সাংবাদিকতার পেশার প্রতি সমাজের দায়িত্বহীনতার একটি নিখুঁত উদাহরণ। তার এই অভিজ্ঞতা আমাদের সবাইকে সতর্ক করে—কীভাবে সত্য এবং সততার সঙ্গে থাকা মানে সমাজের অবহেলার সম্মুখীন হওয়া।
চায়ের আড্ডায় একদিন তিনি ক্ষোভ ও হতাশার সঙ্গে বলেছিলেন-“সততার মূল্য কোথায়?” সেই প্রশ্ন যেন তার জীবনের সারমর্ম। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি কখনো অসততার সঙ্গে আপস করেননি। সবসময় সোজাসাপ্টা, স্পষ্টবাদী ছিলেন, মুখে সত্য কথাই তুলে ধরতেন। কিন্তু এই সততার মূল্য তিনি পেয়েছেন কি? বাস্তবতা ছিল-বারবার অবহেলা, বঞ্চনা, একাকীত্ব, এবং সমাজের নিরব অবজ্ঞা তাকে ঘিরে ধরেছিল। তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে সেই প্রশ্ন আরও জোরালোভাবে বাজতে থাকে। এই দেশে সত্যিই কি সততার কোনো দাম আছে? বিভুদাকে যারা চেনেছেন, তার সঙ্গে চলেছেন, তারা এ প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারে না। আমাদেরও নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে—সত্যের সঙ্গে দাঁড়ানো, সততার পথে থাকা, কি আমরা সমাজের মাধ্যমে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা পেতে পারি? বিভুদার জীবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, সত্য এবং সততার পথ কখনো সহজ নয়, কিন্তু তা যতই কঠিন হোক, তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না।
আমরা একে একে হারাচ্ছি সত্যসন্ধানী সাংবাদিকদের। সাগর-রুনি নেই, ফরহাদ ভাই নেই, আর আজ নেই বিভুদা। এরা সবাই ছিলেন সৎ সাংবাদিকতার প্রতীক, যারা সত্য বলতেন নির্ভীকভাবে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে জুটেছে অবহেলা, বঞ্চনা আর করুণ মৃত্যু। বিভুদার মৃত্যু যেন আরও একবার মনে করিয়ে দিল-এই দেশে সত্য বলা মানে শাস্তি পাওয়া। সাংবাদিকতার মূল শক্তি সততা আর সাহস আজ প্রশ্নবিদ্ধ। পাঁচ দশক ধরে বিভুদা দেশের অসংগতি, সমাজের অন্যায়, মানুষের বেদনা নিয়ে লিখেছেন। তার কলম সবসময় সত্যের পক্ষে ছিল। কিন্তু মজার বিষয় হলো, তিনি অন্যের দুঃখের কথা লিখতে পারলেও নিজের দুঃখ কোনোদিন লেখেননি। কেবল মৃত্যুর আগে তার শেষ কলামে কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। অথচ যদি তিনি আগেই নিজের অভাব, অনটন আর ক্ষোভের কথা লিখতেন, হয়তো আমরা সতর্ক হতে পারতাম। হয়তো পাশে দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু তিনি ছিলেন নীরব যন্ত্রণার মানুষ, অভিমানী মানুষ। সেই অভিমানই হয়তো তাকে শেষ পর্যন্ত রাগে-ক্ষোভে ভেতর থেকে ভেঙে দিল। তার মৃত্যু এখনো রহস্যাবৃত। আত্মহনন নাকি অন্য কিছু-তা তদন্ত শেষে পরিষ্কার হবে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—এই মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এটি আমাদের সামাজিক ব্যর্থতার প্রতীক। সততা, সৎ জীবনযাপন, সৎ সাংবাদিকতার ওপর যে অবহেলা সমাজ চাপিয়ে দিয়েছে, সেই অবহেলার চাপে হয়তো তিনি আর টিকে থাকতে পারেননি।
বিভুদা ছিলেন প্রকৃতপক্ষে সংগঠনবিমুখ মানুষ। তিনি কখনো বড় কোনো সংগঠন বা সমিতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখার প্রতি আগ্রহ দেখাননি। কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ গঠনের সময় আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে অনুরোধ করেছিলাম, যেন তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। তার উত্তর সরাসরি এবং স্পষ্ট ছিল-“দাদা, আমাকে সংগঠনে রাখবেন না। আমি একটু মুক্ত জীবন চাই।” তিনি সেই সঙ্গে বলেন, “সবসময় আছি আপনাদের পাশে।” এই সংক্ষিপ্ত কথাটিই তার চরিত্রের প্রকৃত পরিচয় বহন করে। বিভুদা নিজের প্রয়োজনীয়তা বা স্বার্থের জন্য কখনো কোনো জায়গায় আটকে থাকতেন না, কিন্তু অন্যের পাশে দাঁড়ানোয় তিনি এক মুহূর্তও কৃপণতা দেখাননি। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি নিজের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা স্বীকার করলেও, প্রয়োজন হলে অন্যের সহায়তায় সবসময় সক্রিয় ছিলেন। আজকের দিনে এমন নিঃস্বার্থ মানুষ বিরল হয়ে উঠেছে। বিভুদার মত মানুষ আমাদের সমাজে বিরল রত্নের মতো, যাদের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সহজে পাওয়া যায় না। আমাদের ব্যর্থতাও এ ক্ষেত্রে ছোট নয়। যারা তার চারপাশে ছিলেন, আমরা তার ভেতরের দুঃখগুলো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।
হয়তো কিছুটা বুঝলেও গুরুত্ব দিইনি। সাংবাদিক সমাজের ভেতরে যে আত্মকেন্দ্রিকতা, ব্যক্তিপরায়ণতা এবং প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটিই বিভুদার মতো সৎ ও নিঃস্বার্থ মানুষদের নিঃশব্দে বিদায় নিতে বাধ্য করে। তিনি কখনো স্বতঃসিদ্ধভাবে নিজের কষ্ট প্রকাশ করতেন না, এবং আমরা হয়তো সেই নিঃশব্দ সংকেতগুলোকেই তুচ্ছ করেছি। তার মৃত্যু আমাদের জন্য শুধুই শোক নয়, বরং গ্লানিরও কারণ, কারণ আমরা তাকে সেই মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছি, যা সে প্রকৃতপক্ষে প্রাপ্য ছিল। আমাদের অমন দৃষ্টি এবং মনোযোগের অভাবই বিভুদার মতো মানুষদের সমাজের সামগ্রিক অবহেলায় ফেলে দেয়।
আজকের সাংবাদিকতা এক অদ্ভুত সংকটে পড়েছে। সত্য বলার মানুষ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, আর অসৎ ও স্বার্থপর ব্যক্তিরাই উপরে উঠে আসছে। সৎ মানুষ অবমূল্যায়িত, অবহেলিত, এবং কখনো কখনো একাকী। বিভুদার মৃত্যু যেন আমাদের সামনে সেই নির্মম বাস্তবতাকে আরও প্রকটভাবে তুলে ধরল। একজন মানুষ যখন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বেকারত্বের কষ্ট, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং সামাজিক অবহেলায় ভোগেন, তখন বোঝা যায় সমাজের ভিত্তি কতটা দুর্বল হয়ে গেছে। সাংবাদিকতার পেশা শুধু কলম ও কাগজের খেলা নয়, বরং একটি সমাজের নৈতিক শিকড়ের প্রতিফলন। কিন্তু সমাজ যদি সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিককে সমর্থন না দেয়, তবে সেই পেশার ভিত্তি ক্রমশ নাজুক হয়ে পড়ে।
বিভুদার মৃত্যু আমাদের জন্য বড় এক সতর্কবার্তা। আমরা যদি এখনই পরিবর্তন না করি, যদি সততার মূল্যায়ন না করি, তবে একে একে হারাতে হবে আরও অনেক বিভুরঞ্জনকে। তখন সাংবাদিকতা শুধু চাকরি হয়ে যাবে, কলম শুধু বেতনের হিসাব মেলাবে, আর সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা হারিয়ে যাবে। সমাজের জন্য এটি বড় ক্ষতি, কারণ সত্যকে প্রকাশ করার সাহসী মানুষ ছাড়া কোনো সমাজের নৈতিক ও তথ্যভিত্তিক ভিত্তি টিকে থাকতে পারে না। বিভুদার জীবন এবং মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-সত্যনিষ্ঠতা এবং সততার মূল্য বোঝা শুধু ব্যক্তিগত নয়, তা সমগ্র সমাজের দায়িত্ব।
আমরা তাকে হারালাম। কিন্তু তার প্রতি আমাদের দায় এখানেই শেষ নয়। আমরা যদি সত্যকে মূল্য না দিই, সততাকে সম্মান না করি, তবে তার মৃত্যু বৃথা হয়ে যাবে। বিভুদার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে আমাদের শপথ নিতে হবে-আর কোনো বিভুরঞ্জন যেন রাগে-ক্ষোভে বিদায় না নেন। সাংবাদিক বিভূরঞ্জন সরকার আমাদের শিখিয়ে গেছেন-সত্য লেখা কঠিন, কিন্তু সত্য না লিখে থাকা আরও কঠিন। তিনি লিখেছেন মানুষের পক্ষে, সমাজের পক্ষে, সত্যের পক্ষে। আজ তার মৃত্যু যেন সততার মৃত্যু না হয়, বরং নতুন সততার জন্ম হোক। আমরা চাই, তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে-“সততার মূল্য কোথায়?” যেদিন এই প্রশ্নের উত্তর সমাজ দিতে পারবে, সেদিন হয়তো বিভুদার আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।