শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি : ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে বিজয়ের দ্বার প্রান্তে ১৪ ডিসেম্বর পাক-হানাদার মুক্ত হয় বগুড়ার শেরপুর। পাক-হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এদিন শেরপুরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তাই ১৪ ডিসেম্বর বগুড়ার শেরপুর মুক্ত দিবস।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই শেরপুরে চলে তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে দেশ স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, গঠন হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নির্বাচিত হন তৎকালিন শেরপুর ডিগ্রী কলেজ ছাত্র সংসদের জি,এস ও ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মুক্তি বাহিনী। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন ন্যাপ নেতা সিদ্দিক হোসেন বারি শেরপুর ডি,জে হাইস্কুল চত্তরে চলে কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং পরে শেরপুর থানা থেকে ১৪ টি রাইফেলে দেয়া।

মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেন থানার তৎকালিন হাবিলদার আব্দুল হালিম। তাকে সহযোগিতা করেন থানার দারোগা ওয়াযেদ মিয়া। ২৪ এপ্রিল শেরপুরে পাকবাহিনী প্রবেশ করে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় গাছ কেটে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা চালায় এবং সামান্য অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু পাক বাহিনীর নিকট টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন ভাবে দেশে বিদেশে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরা আরম্ভ করে।

১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারে শেরপুর থানায় ঐ সময় দুই জন কনস্টেবল ও একজন দারোগা আছে। পাক বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে ঐদিনই বিকেলে শেরপুর থেকে পলায়ন করে এবং রাজাকার আশ্রয় নেয় বিহারী অধ্যুষিত উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের ঘোলাগাড়ী গ্রামে। ১৪ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় সারিয়াকান্দী হতে বাচ্চুর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ও ধুনট হতে আকরাম হোসেন খাঁন ও ইউসুফ উদ্দিনের নেতৃত্বে শাহজাহান আলী, খন্দকার আজিজুল হক, মওলা বক্স, মমতাজ উদ্দিন, আব্দুল জলিল, আব্দুর রাজ্জাক, ইমান আলী,

শাহাবুদ্দিনসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা শেরপুর থানা দখল করে। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় মিত্র বাহিনী বগুড়া থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে শেরপুর বাসস্ট্যান্ডে ১৪ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যাম্বুসে পরে যায়। পরে মিত্র বাহিনী ঢাকা অভিমুখে রওনা দেয়। এর পর মুক্তিযোদ্ধারা ঘোলাগাড়ী আক্রমন করে রাজাকর মুক্ত করে। এ সময় রাজাকার আলী আকবর, বুলু আক্তার, দিল মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে মারা যায় এবং কিছু রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ফলে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ শেরপুর হানাদার মুক্ত হয়। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর পার্কের মাঠে (বর্তমানে মহিলা ডিগ্রী কলেজ) স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর দিবসটি শেরপুর হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন পালন করে থাকে।

শেরপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষে শেরপুর শহরের কর্মকারপাড়া চৌরাস্তার মোড়ে ২০০৪ সালে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে। যাতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদারদের হাতে নিহত শহীদদের নামের তালিকা রয়েছে। সংস্কারের অভাবে স্মৃতিস্তম্ভটি বিলীন হতে চলার এক পর্যাযে ২০০৩ সালে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান জানে আলম খোকা সংস্কার পূর্বক বৈদ্যুতিক লাইটের ব্যবস্থা করে। তাছাড়াও শহরের স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডে বিজয় দিবসের ভাস্কর্য ও সকাল বাজার মোড় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রঞ্জন বসাক স্মৃতিস্তম্ভটি দীর্ঘদিন যাবত উপজেলাবাসীর নজরে আসছে না বলে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বেশ আবেগ ও আক্ষেপ করে বলেন।

১৪ ডিসেম্বর শেরপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে বরাবরের ন্যায় শেরপুর প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে এবছর বিকাল ৩ টায় মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিককর্মীদের নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

(এনএএম/এএস/ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪)