স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশ জেলের নাম পরিবর্তন করে ‘কারেকশন সার্ভিস বাংলাদেশ’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।

মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) কারা সদরদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি দায়িত্ব দেওয়ার পর গত এক বছরে কারাগারে নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন।

কারাগার সংশ্লিষ্ট সংস্কার এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে তুলে ধরে আইজি প্রিজন বলেন, তীব্র জনবল সংকটের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে এক হাজার ৮৯৯ নতুন জনবলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং আরও দেড় হাজার জনবলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

কারা বিভাগ সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কারেকশন সার্ভিস অ্যাক্ট ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আইজি প্রিজন জানান, মামলাসহ নানা জটিলতা অতিক্রম করে দীর্ঘ এক যুগ পরে সিনিয়র জেল সুপারসহ সব পদবীতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা প্রশাসনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করছে।

এ ছাড়া নিয়োগবিধি সংক্রান্ত জটিলতায় অনেকগুলো পদে নিয়োগ এবং পদায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না, তাও যুগোপযোগী করে নতুন নিয়োগবিধি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

কারা বিভাগের পোস্টিং বাণিজ্যের বহুল প্রচলিত অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে বর্তমানে সব গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদায়ন করা হচ্ছে এবং তা চলমান রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দিদের স্থান সংকুলানের জন্য নতুন করে দুটি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং চারটি জেলা কারাগার চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া অধিকতর সমন্বয়ের জন্য ঢাকা বিভাগকে ভেঙে দুটি বিভাগ করা হয়েছে।

কারা বিভাগের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত রাখতে নানাবিধ উদ্ভাবনী পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। কারা বিভাগের আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর নিয়োগ পদ্ধতি সরকারি দপ্তর এবং সংস্থার নিয়োগের ক্ষেত্রে মডেল নিয়োগ পদ্ধতি হিসাবে বিবেচনার দাবি রাখে। এতে একদিকে যেমন দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য কমানো গিয়েছে, অন্যদিকে প্রতিটি স্তরেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পেশাদার ভুয়া পরীক্ষার্থীও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

বন্দি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম তুলে ধরে আইজি প্রিজন বলেন, বন্দিদের টেলিফোন কল এবং দেখা সাক্ষাতের বিষয়টি ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হয়েছে যাতে, এক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের কোনরূপ হয়রানীর শিকার হতে না হয় এবং একই সাথে নিবিড় নজরদারিও বজায় রাখা যায়। আমরা এআই নির্ভর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছি। কারাগারে আসা দর্শনার্থীদের সঙ্গে সম্মানসূচক ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সাক্ষাতের সময় তারা যেন হয়রানির শিকার না হন তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বন্দিদের খাবারের মেন্যুতে প্রোটিনের পরিমাণ এরইমধ্যে স্বল্প পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে এবং তা যৌক্তিক পর্যায়ে বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল এবং এরমধ্যে অনুমোদন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সকালের নাস্তা এবং বিশেষ দিবসের জন্যও খাদ্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।

বন্দিদের জামিন প্রক্রিয়ায় যেন কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেজন্য কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে এবং তা নিশ্চিতে প্রতিনিয়ত তদারকি হচ্ছে। হটলাইন সেবা (১৬১৯১) চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সেবাগ্রহীতারা বন্দি সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছেন।

কারাগার থেকেই বন্দিরা অনলাইনে ভার্চ্যুয়াল কোর্টের মাধ্যমে বিচারকার্যে অংশ নিতে পারছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা টুয়েন্টি ইয়ার্স রুলের (কারাবিধি ৫৬৯ ধারা) আলোকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্দিকে এরইমধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণপূর্বক ৫৬৯ ধারায় মুক্তির বিষয়টি সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বন্দিদের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর মাধ্যমে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীও সেবা নিতে পারবেন। বন্দিদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন কারাগারে স্থান সংকুলান সাপেক্ষে নানাবিধ খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ মনন চর্চার সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া তাদের সংশোধনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষাসহ নানাবিধ কাউন্সিলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বন্দি এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী আত্মীয় স্বজনদের প্রাপ্যতা, করণীয় এবং অকরণীয় সম্পর্কে সজাগ করে তোলার লক্ষ্যে ডকুমেন্টারি প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোবল এবং সেবার মান উন্নয়নে নেওয়া কার্যক্রম সম্পর্কে আইজি প্রিজন বলেন, অবসরগামী কারারক্ষীদের আজীবন রেশন দেওয়ার বিষয়টি সরকার নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে, যা বর্তমানে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উন্নতমানের প্যাকেটজাত রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং বিশেষ দিবসে খাবার পরিবেশনের জন্য বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ করা হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শারীরিকভাবে যোগ্য রাখার স্বার্থে ওয়েট চার্ট সুনির্দিষ্টকরণসহ পিটি-প্যারেড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত দ্রব্য দেওয়া হয়েছে।

আইজি প্রিজন বলেন, বিগত সময়ের চ্যালেঞ্জ উপলব্ধি করে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কারারক্ষী গড়ে তুলতে আমরা সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যুগোপযোগী/প্রযুক্তি-নির্ভর প্রশিক্ষণের মডিউল তৈরি করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। বিগত এক বছরে ৬৯১ জন কারারক্ষী, ১৫০ জন প্রধান কারারক্ষী, ৬৯ জন সর্বপ্রধান কারারক্ষী, ৩০ জন সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টর, ৫৫ জন ডেপুটি জেলার ও জেলারদের বিভিন্ন পেশাগত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। গত এক বছরে মাদকসেবন, বহন ও সরবরাহে জড়িত ২৯ জনকে কারাগারে পাঠানোর পাশাপাশি বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে নিজস্ব ডোপ টেস্টিং মেশিন সংগ্রহ করা হয়েছে।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ সময়ে ৩৪ জনকে চাকরিচ্যুত, ৪৪০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা এবং ১৭২ জনকে বদলি করা হয়েছে।

অন্যদিকে, পরিবার নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবা স্কিমে সহায়তা বৃদ্ধি, সুদবিহীন ঋণ, নিয়মিত কাউন্সেলিং এবং কারারক্ষীদের জন্য ১৫ দিনের বাধ্যতামূলক অর্জিত ছুটি চালু করা হয়েছে।

(ওএস/এএস/আগস্ট ২৬, ২০২৫)