আবীর আহাদ


আজকের বিশ্ব এক গভীর সংকটময় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার একতরফা আধিপত্যবাদ, আগ্রাসন ও অর্থনৈতিক শোষণের নীতির মাধ্যমে বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে; অন্যদিকে রাশিয়া, চীন ও ভারত—বিশ্বের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শক্তিধর রাষ্ট্র—একত্রে এগিয়ে আসছে একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার সন্ধানে। আগামী ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ে পুতিন, শি জিনপিং ও নরেন্দ্র মোদীর ঐতিহাসিক বৈঠক তাই নিছক কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং তা হতে পারে বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বরাজনীতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় শত কোটি মানুষ তাই আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে এই ত্রি-পরাশক্তির দিকে—তারা কীভাবে ঐক্যবদ্ধ কৌশল নির্ধারণ করে মার্কিন আধিপত্যের কবল থেকে বিশ্বকে মুক্তির পথ দেখাতে সক্ষম হয়।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে আজকের বিশ্ব রাজনীতি যেন দ্বিতীয় এক শীতল যুদ্ধের অবয়ব নিচ্ছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রপথ, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের কৌশলগত লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু। এই লড়াইয়ে ছোটো দেশগুলোর, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের অবস্থান হয়ে উঠেছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর।

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি এবং মার্কিন ভূমিকা

২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসন ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ চালু করে, যার উদ্দেশ্য ছিলো চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিরোধ করা। এ কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো দক্ষিণ চীন সাগর, মালাক্কা প্রণালী এবং বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতি জোরদার করা। ভারতকে এই কৌশলের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র, আর সেই সুবাদে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে 'QUAD' জোট গড়ে ওঠে।

কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠে: ভারত কি তার বাস্তব ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ভুলে শুধুমাত্র চীনবিরোধিতার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়াবে?

ঐতিহাসিক স্মৃতি ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের কাছে আজও তিক্ত স্মৃতি হয়ে আছে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, তখন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে তার সপ্তম নৌবহর পাঠায় ভারত মহাসাগরে। সেই সময় সোভিয়েত রাশিয়া তার নৌবহর মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্রকে কার্যত প্রতিরোধ করে।

এই ইতিহাস প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই তার নীতি নির্ধারণ করে, বন্ধুত্ব নয়। এ কারণেই একটি প্রবাদ প্রচলিত—“যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার আর শত্রু খোঁজার দরকার নেই!” ভারতের উচিত সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বুঝা, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্রতা মূলত সাময়িক ও আত্মকেন্দ্রিক। বরং চীন ও রাশিয়ার সাথে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এক নতুন এশীয় জোট গড়া যেতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আধিপত্যের জবাব দেবে।

বাংলাদেশ ও মায়ানমার: করিডোর না কৌশলগত টার্গেট?

বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রকল্প এবং খ্রিস্টান এনজিও-র গতিবিধি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। RAND Corporation এবং USIP-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র মায়ানমারের খ্রিস্টান অধ্যুষিত চীন সীমান্তবর্তী অঞ্চল (কাচিন, চিন) ও ভারতের নাগাল্যান্ড-মণিপুরে ভিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামও এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের Indo-Pacific Command (INDOPACOM) সরাসরি স্বীকার করেছে যে, বঙ্গোপসাগর তাদের কৌশলগত নজরদারির আওতায়। একই সঙ্গে ২০২১ সালে কক্সবাজারে মার্কিন Pacific Angel সামরিক মহড়া দেশের ভেতর ও বাইরে অনেক মহলে প্রশ্ন তুলেছে—এটি কি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক উপস্থিতির পূর্বাভাস নয়?

বাংলাদেশী হয়েও কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের স্বার্থান্ধ দালাল, ডলারপ্রেম ও ক্ষমতার মদমত্তে উন্মাদ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বাংলাদেশকে তুলে দেওয়ার এক জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। ওয়াশিংটনের মূল লক্ষ্য হলো—বাংলাদেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে, বিশেষত উপকূলবর্তী কৌশলগত দ্বীপ বা চর এলাকায় অবস্থান নেওয়া। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, চীন ও ভারত—এই দুই সম্ভাব্য সুপার পাওয়ারকে তার কৌশলগত বেষ্টনীতে আটকে ফেলতে চায়।

অতএব, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে মার্কিন কৌশল আজ স্পষ্টতই রাশিয়া-চীন-ভারতের নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের জন্য হুমকিতে পরিণত হচ্ছে।

চীন-রাশিয়া-ভারত ঐক্য: সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা

চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ডশিপ’ অনেক পুরনো হলেও, ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক বরাবরই ওঠানামার মধ্যে ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে BRICS এবং Shanghai Cooperation Organization (SCO)-এর মাধ্যমে এই তিন দেশের মধ্যে একটি ‘মাল্টিপোলার ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ গঠনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।

২০২৩ সালের BRICS সম্মেলনে রাশিয়া, চীন ও ভারত একসঙ্গে বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। একই বছরে SCO বৈঠকে তিন দেশই মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটবাদের বিরোধিতা করে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারতের ভেতরে সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন কিংবা কূটনীতিক ক্যানওয়াল সিবালের মতো অভিজ্ঞ নীতিনির্ধারকরাও প্রকাশ্যে বলেছেন—যুক্তরাষ্ট্র কখনোই নির্ভরযোগ্য কৌশলগত বন্ধু নয়।

যদি ভারত যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর চীনবিরোধী অবস্থান পরিহার করে এবং আঞ্চলিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে এই ত্রিদেশিক শক্তি (চীন-রাশিয়া-ভারত) নতুন এক বিশ্ব ভারসাম্যের ভিত্তি হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি প্রতিরোধের একমাত্র কার্যকর উপায়ও হলো এই আঞ্চলিক ঐক্য।

বিশ্বশান্তি ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে, এমনকি পৃথিবীতে শান্তি চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায্য শক্তির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বারবার প্রমাণ করেছে, তার বিদেশনীতি "শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের" রাজনীতি।

এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যদি যুক্ত হয়ে নিরপেক্ষ, ন্যায়ভিত্তিক এবং বহু-ধ্রুববিশ্ব গঠনে এগিয়ে আসে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা পৃথিবীতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।

এটাই সময়: রাশিয়া, চীন ও ভারত এক হয়ে দাঁড়াক বিশ্বের পক্ষে, শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে। কোটি কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আজ এই ঐক্যের দিকেই তাকিয়ে আছে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।