কালীগঞ্জ প্রতিনিধি : কে এই নাসরিন নাহার শামীমা? যার অকাল মৃত্যু ঘিরে রহস্যে মোড়া হয়ে উঠেছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ। আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যা, এমন প্রশ্নে বিভ্রান্ত সাধারণ মানুষ। সুষ্ঠু তদন্তের দাবিতে সহপাঠী, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছেন ইতোমধ্যেই।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নাসরিন নাহার শামীমার জন্ম এক অদ্ভুত নিয়তির গল্প নিয়ে। তার জন্মদাতা বাবার নাম আব্দুল আলিম। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী রাশিদা বেগমের কোল আলো করে পৃথিবীতে আসেন শামীমা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলায় মাত্র দুই বছর বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। স্বামীর মৃত্যুর মাত্র দুই মাস পর লিভারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মা রাশিদা বেগমও।

রাশিদা বেগম মৃত্যুর আগে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কর্মরত নার্স রাজিয়া সুলতানার কাছে ছোট্ট শামীমাকে দত্তক দিয়ে যান। এরপর থেকেই শামীমার নতুন ঠিকানা হয় পালিত বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা মহবুর আলম ও পালিত মা রাজিয়া সুলতানার সংসারে। তাদের একমাত্র ছেলে পারভেজের পাশাপাশি শামীমাই হয়ে ওঠেন পরিবারের স্নেহভাজন কন্যা।

শৈশব থেকে কৈশোর, আর কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা। সব পথ পেরিয়ে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন নাসরিন নাহার শামীমা। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান “যশোর নার্সিং গাইডলাইন” এ, নার্সিং প্রশিক্ষণের জন্য। দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল স্বপ্নময়ভাবে।

কিন্তু জীবনের ছন্দপতন ঘটে কয়েক সপ্তাহ আগে। মাত্র ২২ বছর বয়সে হারান পালিত পিতা মহবুর আলমকে। মৃত্যুর আগে তিনি শামীমার নামে কিছু টাকা ও সম্পদের মালিকানা দিয়ে যান।

গত ২০ আগস্ট, ২০২৫ বুধবার শামীমা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে জানা যায়। পরের দিনে ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার তার ঘর থেকে উদ্ধার হয় একটি সুইসাইড নোট। শামীমার সহপাঠীরা দাবি করে উদ্ধারকৃত সুইসাইড নোটটি নাসরিনের হাতের লেখা নয়। আত্মহত্যা নয় খুন বলে দাবি করে তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, হত্যা নাকি আত্মহত্যা, এর সুষ্ঠ তদন্তের দাবিতে ২৩ ও ২৪ আগস্ট দুইদিন কালিগঞ্জ মেইন বাস স্ট্যান্ডে মানববন্ধনে নামেন শামিমার সহপাঠী, প্রতিবেশী ও সাধারণ জনগণ।

মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী সহপাঠীরা দাবি করেন, নাসরিন নাহার শামীমা আত্মহত্যা করতে পারেন না। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর দিন সকালেও তারা শামিমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তখন তার আচরণে আত্মহত্যার কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি। সহপাঠীদের কাছে এমনকি কয়েকটি অডিও ক্লিপওস আছে, যেখানে পরিবার থেকে তার ওপর নির্যাতনের প্রমাণ মেলে বলে দাবি তাদের।

ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শম্পা আক্তারের বর্ণনা আরও শঙ্কা জাগায়। তিনি জানান, মৃত্যুর আগের রাত (১৯ আগস্ট) শামীমা ফোনে কেঁদে বলেন, পালিত মা ও ভাই তাকে খারাপ ব্যবহার করছে। পরদিন আশ্রয়ের জন্য তিনি শম্পার বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন। বাড়ির মালিকানা ও আর্থিক বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল, এমনকি সেদিনই থানায় একটি অভিযোগও করেছিলেন শামীমা।

সহপাঠীরা আরো বলেন, পুলিশ অভিযোগের কথা স্বীকার করলেও অভিযোগের কোন কপি তাদেরকে দেখানো হয়নি। এদিকে চার দিন কেটে গেলেও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি। এ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সহপাঠীরা। দ্রুত তদন্ত শেষ না হলে তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

ঘটনার এ পর্যায়ে আবির্ভাব ঘটে শামীমার সৎভাই আলামিনের, যিনি শামীমার জন্মদাতা বাবা আব্দুল আলিমের প্রথম স্ত্রী মাজেদা বেগমের সন্তান।

মানববন্ধনে আলামিন বলেন, “শামীমা যে আমার সৎ বোন হয় তা আমি জানতাম না। শামীমার মৃত্যুর পর আমার চাচা আব্দুল হাকিম আমাকে বিষয়টা অবগত করেন। মৃত্যুর আগে শামীমার সাথে কখনো আমার যোগাযোগ হয়নি।”

মৃত শামীমার মালিকানাধীন সম্পদের জন্য মৃত্যুর পর খোঁজখবর নিতে এসেছেন কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সম্পদের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। আমি শুধু এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার চাই।”

তবে শামীমার রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকেই বলছেন, যদি এটি আত্মহত্যা না হয়ে হত্যা হয়ে থাকে, তবে কি তার পালিত বাবার দেওয়া সম্পদের কারণেই তাকে প্রাণ দিতে হলো? সেই সম্পদের লোভেই কি সৎ ভাই মৃত্যুর পর হঠাৎ খোঁজ নিতে এগিয়ে এসেছে?

(এসএস/এসপি/আগস্ট ২৭, ২০২৫)