প্রসঙ্গ: সেনা প্রধানের বক্তব্য
শাসন করা তারই সাজে….

চৌধুরী আবদুল হান্নান
বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত একটি প্রাচীন প্রবাদ “শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে।” এখানে স্নেহ, মমতা ও শাসন একই সূত্রে গাঁথা। সে কারণে পিতা-মাতা সন্তানকে যেভাবে শাসন করতে পারেন, অন্যরা তা পারেন না।
সম্প্রতি ঢাকা সেনানিবাসে “অফিসার্স অ্যাড্রেস” অনুষ্ঠানে সেনা বাহিনীর সমালোচনা প্রসঙ্গে সেনা কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জবাবে সেনা বাহিনী প্রধান বলেন, ”তারা বড় হলে ভুল বুঝতে পারবে ও লজ্জিত হবে। যারা এসব করছে, তাদের বয়স কম, আমাদের সন্তানের বয়সী।”
সেনা প্রধানের বক্তব্যে তরুণদের প্রতি স্নেহপূর্ণ শাসন রয়েছে, পিতামাতা যেমন তাদের সন্তানদের শাসন করেন।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে বটে কিন্ত মূল চালিকা শক্তি এখনও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী তরুণরা। তাদের দ্বারা গঠিত এ সরকার স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, এমনটি দেখা যাচ্ছে না। সফল আন্দোলন শেষে তারা শিক্ষাঙ্গণে ফিরে না গিয়ে অব্যাহতভাবে নানা ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করছে। তাদের কর্যকলাপ এবং কথাবার্তায় পরিপক্কতা দেখা যাচ্ছে না, তারা সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করছে, ‘৭১ এর স্বাধীনতাকে অস্বীকার করছে যা মেনে নেওয়া যায় না।
এমন বক্তব্য দেওয়ার পরও সরকারের কোনো উপদেষ্টাকে তাদের প্রতি কোনো উপদেশমূলক শাসন বাণীও শোনা যায়নি। অবস্থাটা এমন মনে হচ্ছে যে, নিয়োগ কর্তার বিরুদ্ধে কথা বলা নিরাপদ নয়। এমন চলতে থাকলে অচিরেই মানুষ ভাবতে শুরু করবে, তাঁরা পদপদবি পেয়েই সন্তষ্ট, দেশের কথা ভাবার সময় নেই। বলা হয়েছিল, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার ব্যর্থ হলে আমাদের স্বপ্ন ভেঙে যাবে। ইতোমধ্যে ভাবতে হচ্ছে, আমাদের স্বপ্ন কতটুকু টিকে আছে?
কিছু তরুণ নেতার মুখে স্বাধীনতা বিরোধী কথা উচ্চারিত হওয়ায় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। মানুষের ক্ষোভ পুন্জিভুত হতে থাকলে এক সময় তা বিস্ফোরিত হবে, ইতিহাসের সাক্ষী।
বলা হয়, ৪০ বছর পূর্ণ না হলে মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিপক্কতা আসে না। সরকার পরিচালনায় নেপথ্যে অপরিপক্ক শক্তির হস্তক্ষেপ থাকলে এবং তাতে যদি উপদেষ্টাদের তটস্থ থাকতে হয়, তা হলে যা হবার তাই হবে। এতোদিনে কোনো উপদেষ্টাকে স্নেহের সুরেও তাদের শাসন করতে দেখা যায়নি বরং অনেক ক্ষেত্রে বাহবা দিয়ে আরও বেপরোয়া করে তুলছেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে পারিবারিক আবহে ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠন হয়, মানুষের বুদ্ধিবিত্তিক পরিপক্কতা বাড়ে এবং এর পেছনে কাজ করে বংশ ও পরিবেশ। কোন বংশে জন্ম আর কোন পরিবেশে বেড়ে ওঠা, এই দুইয়ের প্রভাবেই প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র নিয়ে বড় হয়। সে কারণে বিভিন্ন চরিত্রের মানুষদের নিয়ে এক সাথে কাজ করতে গেলে দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়।
“অফিসার্স অ্যাড্রেস” অনুষ্ঠানে সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে সেনা প্রধান আরও বলেছেন- “সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর বার্তা ছড়ানো হচ্ছে, এসব দেখে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না, সতর্ক থাকতে হবে। দেশের মানুষ এখন সেনাসদস্যদের দিকে তাকিয়ে আছেন।”
ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনের সময় সেনা বাহিনী প্রধান নিরপেক্ষতা আর দক্ষতার সাথে যে ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করেছেন, তা জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে চিরদিন স্মরণ রাখবে। তাঁর নেতৃত্বের বিচক্ষণতায় ব্যাপক প্রাণহানি এড়ানো গেছে।
সব কাজ এক সাথে করতে গেলে কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে করা যায় না, বর্তমানে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে মব সহিংসতা দমনে দ্রুত কঠোর হতে হবে। ফলে আগামীতে জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যান্য অগ্রধীকার ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সুসম্পন্ন করার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।
রাষ্ট্র ও সমাজ এভাবে চূড়ান্ত অরাজকতার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে তার দায় নিশ্চয়ই জুলাই আন্দোলনে সফল নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-জনতার ওপর বর্তাবে না, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।