স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকায় আয়োজিত হলো এক অনন্য উৎসব— “বায়োফিলিয়া: মানুষ, জলবায়ু ও সংস্কৃতির পুনর্মিলন”। সুইস দূতাবাসের উদ্যোগে এবং জেনল্যাবের আয়োজনে এ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান মানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক অসাধারণ সমন্বয় রচনা করে।

উৎসবের সূচনা হয় প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। সাঁওতাল নৃত্যশিল্পীদের ছন্দময় নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রের তালে লোকজ সংস্কৃতি ও প্রকৃতির মিলন দর্শকদের আবেগতাড়িত করে। এরপর মঞ্চে আসে “সাউন্ডস অফ দ্য সয়েল” শীর্ষক ফোক ফিউশন পরিবেশনা, যেখানে বাউল শিল্পী, সাঁওতাল সম্প্রদায় ও তরুণ শিল্পীরা একসঙ্গে সৃষ্টি করেন মানুষ ও প্রকৃতির চিরন্তন সম্পর্কের সুরেলা প্রতিধ্বনি।

উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল “থ্রেডস অফ দ্য আর্থ” শিরোনামের টেকসই ফ্যাশন প্রদর্শনী। কবিতা, কোরিওগ্রাফি ও ভিজ্যুয়ালের সংমিশ্রণে প্রাকৃতিক কাপড়, পুনর্ব্যবহৃত ডিজাইন এবং ঐতিহ্যবাহী বুননের প্রতিটি পোশাক পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। পাশাপাশি এই প্রদর্শনীতে অংশ নেয় পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনের পথিকৃৎ দুই সংস্থা ‘সাইক্লো’ (Cyclo) এবং ‘কাদম্বরী’ (Kadambari), যাদের ডিজাইনগুলো টেকসই ফ্যাশনের এক নতুন রূপরেখা উপস্থাপন করে।

মূল মঞ্চের বাইরে ছিল বিভিন্ন উদ্ভাবনী ও অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম, যা গ্রিনহাউস স্পেসের আর্টস অ্যান্ড কালচার রিলেটেড অ্যাক্টিভিটির অংশ ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘ইন লাইট: ল্যান্ড, পিপল, কালচার’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, যেখানে জলবায়ু ও প্রকৃতি নিয়ে প্রায় ৪০টি ছবি প্রদর্শিত হয়। এই ফটোগুলো ধারণ করেছেন এস.এম. আল মোস্তফা রসুল, হাবিবুল হক, আহমেদ সামিউর রউফ এবং শান্তনা চক্রবর্তী। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন সিদ্ধার্থ গোস্বামী, ইশরাত বিনতে রউফ ও মেহেদি হাসান। একই সাথে, একটি প্রাণবন্ত লাইভ আর্ট সেশনে শিশু-কিশোরসহ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম. সাখাওয়াত হোসেন তাদের তুলির ছাপ রেখে যান। তরুণ সমাজের জন্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত একটি ভিআর (ভার্চুয়াল রিয়েলিটি) অভিজ্ঞতা, যা বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। এছাড়াও, ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন অ্যাট লোকাল লেভেল’ (CALL) কর্মসূচির আওতায় তৃণমূল পর্যায়ে জলবায়ু বার্তা পৌঁছানোর জন্য নির্মিত ভিডিওগুলো প্রদর্শিত হয় বিশেষ কিওস্কের মাধ্যমে। পাশাপাশি ছিল ‘ট্রি অফ কমিটমেন্টস’— যেখানে দর্শনার্থীরা জলবায়ু সুরক্ষার জন্য তাঁদের ব্যক্তিগত অঙ্গীকার লিখে ঝুলিয়ে দেন। এই সম্মিলিত আয়োজনগুলো পরিবেশ সুরক্ষায় একাত্মতা ও আশার প্রতিফলন ঘটায়।

নাট্যাংশে তরুণ শিল্পীরা মঞ্চে জীবন্ত করে তোলেন জলবায়ু সংকট ও মানবিক দায়িত্বের গল্প। আর সন্ধ্যায় প্রখ্যাত নাট্যদল প্রাচ্যনাট উপস্থাপন করে পরিবেশ ও মানুষের সংগ্রাম নিয়ে এক মর্মস্পর্শী নাটক, যা দর্শকদের গভীরভাবে নাড়া দেয়।

দিনের শেষ ভাগে মঞ্চ মাতিয়ে তোলে জনপ্রিয় ব্যান্ড জলের গান। কণ্ঠশিল্পী কনক আদিত্য ও তার সহশিল্পীদের পরিবেশনায় “বন্ধু”, “বকুল ফুল” ও “এমন যদি হতো” সহ বিভিন্ন গান উৎসবের আবহকে করে তোলে আবেগঘন ও অনুপ্রেরণামূলক। সুরের ভাঁজে উঠে আসে নদী, প্রকৃতি ও টিকে থাকার গল্প। সমাপ্তি ঘটে “ইকোস অফ দ্য ডেল্টা” শীর্ষক সংগীত, নৃত্য ও গল্প বলার কাব্যিক উপস্থাপনার মাধ্যমে, যা দর্শকদের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে।

অতিথি ও অংশগ্রহণকারীদের মতে, সংস্কৃতির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম। তাদের ভাষায়, “এমন আয়োজন শুধু বিনোদন দেয় না, বরং আমাদের প্রকৃতিকে ভালোবাসতে ও রক্ষা করতে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করে।”

সুইস দূতাবাস, জেনল্যাব এবং ক্লাইমেট অ্যাকশন অ্যাট লোকাল লেভেল (কল) কর্মসূচির অংশীদার বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আয়োজিত এ উৎসব প্রমাণ করেছে যে, শিল্প, সংস্কৃতি ও সঙ্গীত টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার পথে অনুপ্রেরণার শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।

(পিআর/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২৫)