বিপদের বন্ধু লোকনাথ বাবা ও তাঁর অলৌকিক কাহিনী

মানিক লাল ঘোষ
যতই দিন যাচ্ছে ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আধ্যাত্মিক শক্তি ও তাঁর মাহত্ম্য প্রচারের সংখ্যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে। শুধু ভারতবর্ষেই নয় বিশ্বের যে কোন জায়গায় যেখানেই সনাতনীদের বাস সেখানেই গড়ে উঠছে লোকনাথ ব্রহ্মচাীর আশ্রম ও মন্দির। দিন দিন তাঁর ভক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকনাথ বাবার জম্ম তিথি ১৮ ভাদ্র আবির্ভাব উৎসব ও ১৯ জৈষ্ঠ্য দেহত্যাগের দিন তিরোধান দিবস সনাতনীদের কাছে আজ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জাতিভেদ নির্বিশেষে লোকনাথ বাবার আবির্ভাব উৎসব আজ সার্বজনীন উৎসবে পরিনত হয়ছে। স্থানভেদে কমপক্ষে তিনদিন থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত চলে এর আনুষ্ঠানিকতা।
ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান ছিলেন লোকনাথ ব্রাহ্মচারী। কারো কারো মতে লোকনাথ বাবা ছিলেন জাতিশ্বর। তিনি পশ্চিম বঙ্গের কলকাতার নিকটে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাত মহকুমার চৌরাশি চাকলা গ্রামে মতান্তরে কচুয়া গ্রামে ১৭৩০ সালের ৩১ শে আগস্ট বাংলা ১১৩৭ সালের ১৮ ভাদ্র জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতার নাম রামনারায়ন ঘোষাল এবং মাতার নাম কমলা দেবী
বাবা লোকনাথ শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমীতে ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে আগস্ট[১] (১৪ ই ভাদ্র, ১১৩৭ বঙ্গাব্দ) কলকাতা থেকে কিছু দূরে বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার কচুয়া গ্রামে (কচুয়াধাম নামে পরিচিত) একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। (যদিও লোকনাথ ব্রাহ্মচারীর জন্মস্থান নিয়ে শিষ্যদেরও ভেতরে বিতর্ক আছে। নিত্যগোপাল সাহা এ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন ও রায় অনুযায়ী তার জন্মস্থান কচুয়া বলে চিহ্নিত হয়।) তিনি ছিলেন তার বাবা-মায়ের ৪র্থ পুত্র।
পিতা রামনারায়ণ ঘোষাল ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যাক্তি এবং গুপ্তসাধক। তার বাসনা ছিলো একজন সন্তানকে ব্রহ্মচারী করবেন। কিন্তু মাতৃমায়ায় আচ্ছন্ন মা তাঁর পুত্রদের ব্রহ্মচারী হতে সম্মতি দিতে চাইছিলেন না। শেষে চতুর্থ সন্তান লোকনাথের জন্ম হলে মাতা কমলা দেবী নিজ হতেই ব্রহ্মচারী হওয়ার সম্মতি দেন।
এরপর রামনারায়ণ, আচার্য গাঙ্গুলী(ভগবান চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়)-কে লোকনাথের আচার্য রূপে উপনয়ন সংস্কার করিয়ে আধ্যাত্ম জীবনের গুরুভার গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানালেন। আচার্য গাঙ্গুলী ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান এবং সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত গৃহী সন্ন্যাসী। তিনি চৌরাশীচাকলা গ্রামের নিকটে কাঁকড়া গ্রামে বাস করতেন। গ্রামটি কচুয়া নামে পরিচিত ছিল। উপনয়নের জন্য লোকনাথ আচার্য গাঙ্গুলীর শিষ্যত্ব লাভ করেন। একই সঙ্গে তাঁর প্রিয় সখা বেণীমাধব চক্রবর্তী ভগবান গাঙ্গুলীর শিষ্যত্ব লাভ করেন। এ সময় লোকনাথ ও সখা বেণীমাধবের বয়স ছিল ১১ বছর এবং আচার্য গাঙ্গুলীর বয়স তখন ৬০। এরপর আচার্য গাঙ্গুলীর সাথে দুজন বালক বেদোক্ত বিধিমত নৈষ্ঠিক-ব্রহ্মচারী হয়ে গৃহস্থাশ্রম ত্যাগ করেন।
গৃহ ত্যাগের পর বাংলা ১১৪৮ সনে আচার্য গাঙ্গুলী তাদের নিয়ে আসেন কালীঘাটের শক্তিপীঠে। একান্ন পিঠের অন্যতম মহাপীঠ কালীঘাট। তৎকালে কালীঘাট ছিল ঘন জঙ্গলময়। কালীঘাটে আসার পর বাল্য ব্রহ্মচারীদ্বয় আচার্যকে সাধন-ভজন শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেন। সাধন-ভজনের জন্য নির্জন স্থানের উদ্দেশ্যে তারা কালীঘাট ত্যাগ করেন। নির্জন স্থানে এসে শিষ্যদ্বয় কঠোর সংযম পালন করেন এবং দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর নক্ত-ব্রত (দিনে অনাহারী থেকে রাত্রে আহার) ধারণ করেন। এরপর একান্তরা-ব্রত (একদিন উপবাসের পর দিন আহার), ত্রিরাত্রি, পঞ্চহ, নবরাত্রি ব্রত পালন করেন। আচার্য গাঙ্গুলী তাদের ধ্যান ও যোগ শিক্ষা দেন। এরপর সিদ্ধলাভের জন্য তারা হিমালয়ের বরফাবৃত এক নির্জন স্থানে উপস্থিত হলেন। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় কঠিন তপস্যা দ্বারা লোকনাথ সমাধির উচ্চতম শিখরে পৌছান এবং পরমতত্ত্ব লাভ করেন। তখন তার বয়স ৯০ বছর।
মহাজ্ঞানী গুরু ভগবান গাঙ্গুলী লোকনাথ (লোকনাথ ঘোষাল) ও বেণীমাধব (বেণীমাধব বন্দোপাধ্যায়) উভয়ের আচার্য গুরু ছিলেন
বাবা লোকনাথের আধ্যাত্মিক শক্তি সম্বন্ধে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। অন্যের মনের ভাব অবলীলায় বলে দিতে পারতেন তিনি। অতি অল্প সময়ে বারদীতে বাবা লোকনাথের যশ ও খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার লোভী ব্রাহ্মণসমাজ তাঁকে হিংসে করে। এমনকি তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ারও বিভিন্ন অপচেষ্টা করা হয়।
একবার জমিদারের ইচ্ছায় কামাখ্যা নামের এক অহংকারী কালীসাধককে বাবা লোকনাথের সিদ্ধিজ্ঞান লাভের প্রমাণ দিতে বলা হয়। কামাখ্যা বাবা লোকনাথকে কথা দেন যদি বাবা লোকনাথ সিদ্ধপুরুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে পারেন, তবে কামাখ্যা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন। তখন বাবা লোকনাথকে কামাখ্যা এবং শিষ্যের সহায়তায় ধুতরা ফুল এবং ভয়ঙ্কর সাপের বিষ দেওয়া হয়। স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করার পর সবাই লোকনাথ বাবার চিতা সাজিয়ে রাখেন। এমনকি তাঁকে অজ্ঞানরত অবস্থায় শোয়ানো পর্যন্ত হয়। কিন্তু চিতায় অগ্নি দাহের মশাল হাতে নেওয়ার পরে লক্ষ্য করা যায় যে তাঁর ওপরে অবিরত ধুতরা ফুল পড়তে থাকে। কিন্তু এক বিস্ময়কর ব্যাপার যে বাবা লোকনাথ মহাদেবের কৃপায় দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এতে করে সমগ্র ব্রাহ্মণসমাজ এবং এমনকি কামাখ্যা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
লোকনাথ বাবার অসংখ্য অলৌকিক ঘটনার মধ্যে অন্যতম কাহিনি একবার বারদীর পাশের গ্রামে এক ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়লে সবাই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাবা লোকনাথ মমতার সঙ্গে রোগীদের সুস্থ করে তোলেন। এই ঘটনায় একদিকে তার মানবিকতা অন্যদিক তাঁর মধ্যে বিরাজমান আধ্যাত্মিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
আর একটি ঘটনা যা হিন্দু ধর্মের পাঠ্যবইয়ে রয়েছে। কোর্টের বাইরে একবার ঔৎসুক জনতার ভিড়, সবাই এসেছে কঙ্কালসার এক সাধককে দেখতে, যিনি এই কেসের অন্যতম সাক্ষী। আইনি এই লড়াই চলছে বারদীর জমিদারের সঙ্গে এক ব্রহ্মচারীর, যাকে জমিদারের উচ্ছৃঙ্খল পুত্র শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করেছে। ব্রহ্মচারীর সাক্ষী হয়ে সাধক কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন ।জমিদার পক্ষের উকিল তাঁকে বয়স জিজ্ঞাসা করলে সাধক উত্তর দিলেন, দেড়শো বছর। সবাই অবাক। জমিদারের উকিল বিচারককে বললেন, ‘ধর্মাবতার, আপনি নিশ্চই বুঝতে পারছেন এই সাধক মানসিক ভাবে সুস্থই নয়। বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মে কোনও মানুষ দেড়শো বছর বাঁচতেই পারে না । উকিল সাধকের কাছে আবার এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনি বলছেন, আপনি স্বচক্ষে ঘটনাটি দেখেছেন, দেড়শো বছর বয়সে আপনার দৃষ্টিশক্তি এত পরিষ্কার যে আপনি প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূর থেকে সবকিছু দেখতে পেলেন, সবাইকে চিনতেও পারলেন’!
সাধক মৃদু হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, আদালতের বাইরে,দূরে ঐ যে কদম গাছটি দেখা যাচ্ছে, ওর পশ্চিম দিকের মোটা ডালটায় কোনও প্রাণীকে দেখতে পাচ্ছো’? সবাই গাছটার দিকে তাকিয়ে কিচ্ছু দেখতে পেল না। সাধক হেসে ফেলে বললো, ‘তোমাদের বয়স কম, দৃষ্টিশক্তিও ভালো, তবুও কিছু দেখতে পাচ্ছো না? আমি কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ওই ডাল বেয়ে সারি সারি পিঁপড়ের দল উপরের দিকে উঠছে, বিশ্বাস না হলে তোমরা কাছে গিয়ে দেখে আসতে পারো’। সাধকের কথা শুনে সবাই অবাক।
বিচারপতির নির্দেশে সবাই মিলে গাছের তলায় গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
এক সময় লোকনাথ বাবা ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে এক বৃক্ষের নীচে সাধনা করতেন। কেউ কেউ তখন তাঁকে পাগল ভাবত। একবার এক অপরাধী ডেঙ্গু কর্মকার যার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা ছিল সে বাবার কাছে গেলে বাবা বললেন তুই মুক্তি পাবি। পরদিন সত্যি সত্যিই ডেঙ্গু কর্মকার খালাস পান। তখন ডেঙ্গু কর্মকারের অনুরোধে বাবা বারদী গ্রামে যান। বারদীতে বাবা কে অনেকেই পাগল ও নীচু বলে ভাবত । সেখানে একবার কয়েক জন ব্রাহ্মণ গ্রন্থি দিতে গিয়ে পৈতাতে জট লাগিয়ে ফেললে খুলতে পারছিলেন না। সেদিন লোকনাথ ব্রহ্মচারী গায়ত্রী জপ করে জট খুলে দেন । ব্রাহ্মণগণ তখন বুঝতে পারেন যে ইনি কোন মহাপুরুষ হবেন নিশ্চিতভাবেই। লোকমুখে বাবার মাহাত্ম্য প্রচার হতে থাকে।
বারদীর জমিদার নাগ মহাশয় লোকনাথ বাবার পছন্দ অনুযায়ী জমি দান করে আশ্রম করে দিলেন । লোকনাথ বাবার অলৌকিক ঘটনার বেশির ঘটেছে বারদীতে। এর ফলে খুব দ্রুততম সময়ে বারদীর আশ্রম তীর্থস্থানের মর্যাদা পেল। আশ্রমে দিন দিন ভক্তদের সমাগম বাড়তে থাকে। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে জ্ঞানী গুণী ও রাজন্যবর্গ বাবার দর্শন ও আশীর্বাদ পেতে আসতে থাকলে লোকনাথ বাবার পূজা শুরু হয়। আজ বারদী লোকনাথ আশ্রম বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতি তীর্থস্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আজ ঘরে ঘরে যে ফটো তে বাবার পূজা হয় সে ফটো তুলেছিলেন ভাওয়াল রাজা বাবার বিশেষ অনুমতি নিয়ে।
বারদী অবস্থান কালে ভক্তগণ কৃপার জন্য তার নিকট আসতেন লোকনাথ ব্রাহ্মচারীর কাছে। এক ভক্ত তার পুত্রের দুরারোগ্য যক্ষ্মার মুক্তির জন্য তার নিকট আসেন। লোকনাথ বুঝতে পারেন সেই পুত্রের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। তবুও ভক্তকে কৃপা করে যক্ষ্মা রোগ নিজ শরীরে গ্রহণ করেন। পুত্র ধিরে ধিরে রোগ মুক্ত হলেও যক্ষ্মা রোগ লোকনাথের শরীরে ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে। এরপর ১৯ জৈষ্ঠ্য তিনি তার দেহত্যাগের ঘোষণা দেন। এই সংবাদ পেয়ে ভারাক্রান্ত ও অশ্রুসিক্ত ভক্তগণ দলে দলে আসতে থাকে বারদীর আশ্রমে। সেখানে তিনি সবাইকে প্রসাদ গ্রহণ করতে বললেন।
এরপর ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (১ জুন ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ)[৪], এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ১১টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের বারদী আশ্রমে মহাসমাধি মগ্ন হলেন। এসময় তার বয়স ছিল ১৬০ বছর।
প্রত্যেক ভক্তকে পিতৃস্নেহ দিয়ে অপরিসীম মমতায় আগলে রাখতেন লোকনাথ ব্রহ্মচারী। আমৃত্যু ভক্তদের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসার বিশ্বাসে একসময়ের লোকনাথ ঘোষাল সিদ্ধি লাভ করে লোকনাথ ব্রাহ্মচারী থেকে হয়ে ওঠেন লোকনাথ বাবা। আর এ বিশ্বাস ও আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে যখনই তার ভক্তরা কোন বিপদে পড়েছে তাঁকে স্মরণ করে পেয়েছে সমাধান ও মুক্তির ঠিকানা। তাইতো চারদিকে আজ জয় বাবা লোকনাথের জয়ধ্বনি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।