আর্থিক খাত ঘুরে দাঁড়াতে বিশেষ পদক্ষেপ

চৌধুরী আবদুল হান্নান
সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নাসা গ্রুপের রপ্তানিমুখী তৈরি পোষাক কারখানাগুলো সচল রাখার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গ্রুপটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার অবৈধ অর্থ অর্জন ও মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। কারাবন্দী থেকে তো আর এত বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সরকারের দেওয়া বিশেষ ব্যবস্থায় কারাগারে থেকেই ব্যবসায় প্রয়োজনীয় নথিতে সই করতে পারবেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।
শ্রম সচিব বলেন, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পর বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করে এমন অনুমতির কথা জানায়, যাতে তারা এলসি খুলে ব্যবসাটা চালু করতে পারেন।
জানা গেছে, চেয়ারম্যান কারাগারে যাওয়ার পর ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে স্বাভাবিক নিয়মেই ব্যাংক থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রপ্তানি বাজার থেকে সরাসরি ক্রয়াদেশ পাওয়া যায় না, বিভিন্ন প্রতিষ্টানের সঙ্গে সাব কন্টাক্টের মাধ্যমে কিছুটা কাজ চালানো সম্ভব হলেও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন সংকুলান হওয়াই কঠিন। রপ্তানি বানিজ্য পরিচালনায় বিদেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরি করতে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে ব্যাংকের আর্থিক সাপোর্ট প্রয়োজন হয়।
মূলত শিল্পান্চলে অস্থিরতা রোধ এবং শ্রমিকদের কর্সংস্থান ও রপ্তানি আয়কে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশে উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি থেকে আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, এই দুই খাত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমশ বৃদ্ধি করে চলেছে। বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে যা আগের তুলনায় স্বস্তাদায়ক অবস্থানে রয়েছে বলা যায়।
সব সময় শতভাগ নিয়ম মেনে কাজ করা যায় না, বৃহত্তর প্রয়োজনে মাঝে মাঝে নিয়ম ভঙ্গ করাটাও জরুরি হয়ে পড়ে। মানুষের কল্যান, জাতির কল্যানের জন্যই তো সব আইন আর নিয়ম-কানন।
রপ্তানিমুখী শিল্প রক্ষায় সরকারের ব্যবসাবান্ধব এমন ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী মহলে আশার আলো সঞ্চার করবে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ইতোমধ্যে আর্থিক খাত অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিগত সরকার পতনের পর ব্যাংক ও আর্থিক খাত ধ্বংসের যে ভয়াবহ চিত্র উম্মুক্ত হয়ে পড়ে, আগে তা মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি। এত দুর্নীতি পৃথিবীর কোথাও হয়নি।
এমন অবস্থা থেকে রাতারাতি উত্তোরণ সম্ভব নয়, তবুও সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে অগ্রসরমান এবং এটাই আমাদের কাছে আশা জাগানিয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেদিন বলেছেন, আমনতকারীদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিরাপত্তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কেউ আমানতের টাকা হারাবেন না সেদিন থেকেই ব্যাংকের প্রতি জনআস্থা ও বিশ্বাস ফিরে আসছে।
কারাগারে বন্দী থেকে ব্যবসা পরিচাসনার জন্য নাসা গ্রুপকে দেওয়া বিশেষ ব্যবস্থা অন্যান্য কারাবন্দী শিল্পপতিদের জন্য উম্মুক্ত করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে।
অর্থ আত্মসাতকারী, পাচারকারী বা ঋণ খেলাপি বড় ব্যবসায়ী যারা কারাগারে আছেন, তারা জামিন পেতে অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে আছেন, বড় অংকের টাকা জমা দেওয়ার শর্তে তাদের জামিনের বিষয়টি আদালতে তোলা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকবেন মামলার বাদী ও বিবাদীর মনোনীত প্রতিনিধিরা যাতে আদালতের নিকট গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব উপস্থাপন করা যায়। আমাদের মূল উদ্দেশ্য অর্থ উদ্ধার, কাউকে কারাগারে আটক রাখা নয়।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রয়োজনে অস্বাভাবিক পথ বেছে নিতেই হয়। আপদকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের সকল কাজ স্বাভাবিকভাবে করতে পারছে, তা বলা যায় না, অনেক ক্ষেত্রেই লেঁজেগোবরে অবস্থা। তাদের সদিচ্ছার অভাব আছে তা মনে হয় না, তবে সক্ষমতার অভাব রয়েছে বলাই যায়।
দেশের চলমান অরাজক পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বিশেষ ব্যবস্থায় ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন, তা প্রশংসনীয়।
অর্থনীতির মেরুদন্ড ব্যাংক ও আর্থিক খাত এভাবে পুরোপুরি কাঙ্খিত অবস্থায় ফিরে এলে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ নিশ্চয়ই উজ্জ্বীবিত হতে থাকবে, এমন প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।