রিয়াজুল রিয়াজ


একজন সংবাদকর্মী হিসেবে শুক্রবার যখন আমি ভাঙ্গায় চলমান বিক্ষোভের ঘটনাস্থলে পৌঁছাই তখন সকাল সাড়ে ১০টা। ঘটনাস্থলে গিয়ে যখন মনে হয়- ভাঙ্গা'র যে দু’টি ইউনিয়ন নিয়ে এই বিক্ষোভ তার একটি আলগী ইউনিয়নেই আমার শিকড়, আমার শৈশব, আমার বাপ-দাদা'র ঠিকানা, আমার ভালোবাসার মানুষগুলে। এসব যখনই ভেবেছি তখনই বিক্ষোভকারীদের প্রতিটি স্লোগান আমাকে ইমোশনাল করে ফেলেছে, নিজের মাটির ঠিকানা রক্ষা করতে তাদের দলে ডাকছে বারবার। কিন্তু আমি তাদের হয়ে আসিনি। এসেছি রাষ্ট্রের চার নম্বর খুটি হয়ে, আমার পেশাগত দায়িত্বে। এই কথা যখনই ভেবেছি ক্যামেরার লেন্স সরেনি, কলম থামেনি! তবে, মাঝে মধ্যেই কেঁপে উঠেছে আমার শবীর, লিখতে গিয়ে কেঁপেছে আমার হাত, কলম! ছবি তুলতে গিয়ে কেঁপে উঠেছে আমার ক্যামেরার স্ট্যান্ড, লেন্স সহ আমার সবকিছু! এদিকে, মহাসড়ক অবরোধ সরাতে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তকর্তাদের দৌড় ঝাপ, জনভোগান্তি রোধে তাঁদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও কোনো এক সময় বিক্ষোভকারীদের কাছে তাঁদের অসহায়ত্ব মনোভাবের ছাপ আমাকে কষ্ট দিয়েছে। কষ্ট পেয়েছি এসময় আটকে পড়া দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের শতশত যানবাহন ও প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ ওই যানবাহনের যাত্রীদের ভোগান্তির কথা ভেবেও।

এসবের মধ্যেই আমার মন সার্বক্ষণিক কামনা করেছে, 'সরকার থেকে শীঘ্রই ঘোষণা আসুক, ভাঙ্গা থেকে দু'টি ইউনিয়ন সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। একটা নিউজ কভার করতে এসে এতোসব কষ্ট, ভাবনার কারণ একটাই- 'ভাঙ্গা' আমার নিজের শিকড়। আমার চৌদ্দ পুরুষের প্রথম ঠিকানা: 'আলগী ইউনিয়ন, ভাঙ্গা উপজেলা, ফরিদপুর জেলা' - ব্যক্তিগত জীবনে এই ঠিকানার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই। যেতেও চাই না।

যাহোক, প্রিয় পাঠক! আমার এই লেখাটির প্রথান শিরোনামে উল্লেখিত 'ভাইডি! সময় কিন্তু ৪৮ ঘন্টাই দিবা নে'- কথাটুকু আমার মুখের কথা নয়, কথাগুলো শুক্রবার ভাঙ্গায় সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের একটি প্রতিক্রিয়া। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্তৃক ভাঙ্গা উপজেলার দুটি ইউনিয়নকে পৃথক করায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে করা ওই বিক্ষোভে ফেটে পড়া জনগণের মুখের কথার অংশবিশেষই আমার আজকের লেখার প্রধান শিরোনাম করেছি।

যাহোক, শুক্রবার পড়ন্ত বিকেলে ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (টিএনও) মো. মিজানুর রহমান ভাঙ্গাবাসীর সমস্যাটি সমাধানে ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের বরাত দিয়ে আন্দোলনকারীদের থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় চেয়ে নেন। টিএনও মিজানুরের পজিটিভ আশ্বাসে সড়ক ছাড়ার সময় স্থানীদের মধ্যে কাউকে কাউকে ভাঙ্গা এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় ও তাদের বিপ্লবী মানসিকতায় বলতে শোনা যায়, 'ভাইডি! সময় কিন্তু ৪৮ ঘন্টা-ই দিবানে।' সেসময় তাদের আরও বলতে শোনা যায়, '৪৮ ঘণ্টার ১ সেকেন্ডও কিন্তু বেশি দিবানে না। আর আজকের কথা না রাখলে, পরের আন্দোলন কিন্তু একের হবেনে ভাইডি, কইয়া গেলাম।' কেউ কেউ বলেন, 'আমাগো তো চিনে নাই, ভাঙ্গা'র মানুষ আমরা। আমাগো ভাঙ্গা আগে যেরম আছোলো, হেরম থাকলেই অবে নে', 'লাগে জান দিবা নে, তাও ভাঙ্গা আলাদা হবার দিবানে না'... ইত্যাদি, ইত্যাদি। বারো জনের তেরো কথা, কথাগুলো যথাযথ, নাকি কথার কথা; তা বোঝা যাবে ৪৮ ঘণ্টা পরে বা ইউএনও এর নেওয়া নির্ধারিত সময়ের আগেই, হয়তো!

প্রিয় পাঠক! শুক্রবার সন্ধ্যায় ভাঙ্গার বৃষ্টিভেজা বৃষ্টিস্নাত রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রস্থানরত শতশত আন্দোলনকারীর মুখে এসব কথাবার্তা শুনে নিজের অজান্তেই কেমন যেনো হয়ে গেলাম। অতি সাধারণ মানুষগুলো নিজস্ব ভাষায় যেনো এতোটুকুই আমাকে বুঝিয়ে গেলেন,'বেটা আমাদের মধ্যে যে মাতৃভুমিপ্রেম আছে, তা তোর মধ্যে নেই! যদি থাকতো তবে তুইও সাংবাদিকতার কলম ও ক্যামেরার লেন্স ছেড়ে আমাদের সাথে এসে বলতিস যে, 'ভাঙ্গা থেকে আমরা কিছুতেই আলাদা হবো না! কেউ তা করতে পারবেনা!.. এমন ভাবনা আমার মনে আসতেই নিজের অজান্তেই দু'চোখ ভিজে গেলো। নিজেকে কোনোভাবে সামাল দিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রজ্ঞাপনটি বেশ কয়েকবার পড়লাম। প্রজ্ঞাপন দেখে মনে হলো- সত্যিই তো আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আমার ঠিকানা থেকে, আমার দাদা'র ঠিকানা থেকে! আমি ভাগ হয়ে যাচ্ছি বাপ-চাচা, চাচাতো ভাই বোন থেকে। সবচেয়ে বড় কথা- আমার বাপ-দাদার মুন্সীর গোষ্ঠী ভাগ করে ফেলা হচ্ছে একটা অদৃশ্য বর্ডারের মধ্যে, দুইটি রাজনৈতিক আসনে। মনে হলো, আমার যে দাদা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশে দীর্ঘদিন আলগী ইউনিয়নের জনগণের চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই আলগী এখন ভাঙ্গা থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে, আমার ওই দাদার কবরটিও আর তার ভালোবাসার জণগণের সাথে থাকছে না। আমরা রক্ষা করতে পারছি না?

আমাদের গোষ্ঠীটি প্রথমবার ভাগ হয়েছিলো যখন ভাঙ্গা পৌরসভায় রুপান্তরিত হয়। আমার পুর্ব পুরুষদের এক অংশ পৌরসভার মধ্যে আরেক অংশ পড়ে থাকে আলগী ইউনিয়নের শুরুতে। তবে সে সময় স্থানীয় নির্বাচনে আমাদের পারিবারিক ভোট ব্যাংক কমলেও স্বান্তনা এতোটুকু ছিলো, আমরা তো আর ভাঙ্গা থেকে আলাদা হয়ে যাইনি। এখন তো সেই সান্ত্বনা টুকুও নেই। এখন তো পুরাই ভাঙ্গা থেকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে আমাদের। এটা কেমনে মানতে পারি? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মন আবার আমাকে সতর্ক করে বলে উঠলো- বৎস! তুমি সংবাদ সংগ্রহ করতে এসেছো, আন্দোলন করতে নয়।'

ফরিদপুর থেকে ভাঙ্গা আসার প্রাক্কালে ভেবেছিলাম, পেশাগত কাজ শেষে নিজের বাপ-দাদার ভিটা আমাদের ভাঙ্গার গ্রামের বাড়ীতে যাবো, রাতটি সবার সাথে কাটিয়ে শনিবার আবার ফরিদপুরে ফিরে যাবো। নিয়ত করে বের হলেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলিয়ে গ্রামের বাড়ীতে না গিয়ে এক সহকর্মীর সাথে ফরিদপুরে ফিরে আসলাম।

ফরিদপুর এসে মনে হলো বাড়ীতে যাইনি ঠিকই করেছি! যদি বাড়ীতে যাওয়ার পথে মুন্সীবাড়ীর পারিবারিক কবরস্থান থেকে আমার চেয়ারম্যান দাদা (আগলী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস ছত্তার মুন্সী, আমার বাবার ছোটচাচা) আমাকে পিছন থেকে ডাক দিয়ে বলতেন, 'কুটি মুন্সী (আমাকে যে নামে ডাকতেন) নিজেদের গোষ্ঠীকে আর আলাদা হতে দিওনা। তোমার পুর্ব পুরুষের ঠিকানা ভাঙ্গা এবং আলগী। তেমাদের গ্রামটি উপজেলা শহরের এতো নিকটবর্তী হয়েও কেনো ভাঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে যাবে? মনে রেখো, 'আলগী ইউনিয়ন ও ভাঙ্গা তোমার মূল ভূখন্ড, তোমার ও তোমার পূর্ব পুরুষের ঠিকানা, তোমার আমার গর্ব ও অস্তিত্ব। আলগী যেনো ভাঙ্গা থেকে আলাদা না পারে, এটা তোমার দায়িত্ব!' এমনটি সত্যি ই হলে তো আমি বিপদেরই পড়ে যেতাম। আমি তো তাঁকে মুখের ওপর বলতেও পারতাম না যে, 'দাদা! আমি একজন একজন সাধারণ সংবাদকর্মী মাত্র, আমার কথা তো উর্ধতন কর্তাব্যক্তিরা নাও শুনতে পারেন, আমি কিভাবে কি করবো? আমিতো রাজনীতিও করিনা স্লোগান-আন্দোলন-সংগ্রাম করে আদায় করবো! রাজপথে আমাকে থাকতে হয় শুধুমাত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্বম্ভের ভুমিকায় সংবাদ সংগ্রহের জন্য, স্লোগান দেওয়ার জন্য নয়। মনে পড়ে গেলো, আপনি একটা প্রশ্ন করেছিলেন, লেখা পড়া করে বড় হয়ে কি হতে চাও? -ক্লাস টু তে পড়া আমি বলেছিলাম, আপনার মতো চেয়ারম্যান হতে চাই। আপনি হেসে দিয়ে বলেছিলেন, দাদা তো তোমার মতো স্মার্ট না, তাই চেয়ারম্যান হইছে, তোমরা বড় হয়ে এমপি হবা। এমপি শব্দটাই সেদিন আমার প্রথম শুনেছিলাম। যাহোক, 'আমি তো তাঁকে এটাও বলতে পারতাম না যে, দাদা আমি আপনাকে বলা স্বপ্নের মতো করে তৈরি হইনি আমি।' দাদা'র ওসব অলৌকিক প্রশ্নের জবাব এড়াতে তাই বাড়িতে না গিয়ে ফিরে এসেছি। ভাবছি ইউএনও মিজানুর রহমান কথা রাখলে যাবো, তখন আর তিনি আটকাতে পারবেন না বা আটকাবেন না, নিশ্চয়ই!

য়াহোক, এবার দেখা যাক কি ঘটলো শুক্রবার: ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলার ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৪ আসন থেকে ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ও হামিরদী এই দুটি ইউনিয়নকে ফরিদপুর-২ (সালথা-নগরকান্দা) আসনে অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

এর প্রতিবাদে (৫ সেপ্টেম্বর) শুক্রবার সকাল থেকে ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়ক এবং ফরিদপুর থেকে ভাঙ্গা ইন্টারচেঞ্জ পর্যন্ত মহাসড়কের দুটি পয়েন্ট বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল করছেন স্থানীয়রা। এতে ভাঙ্গা ইন্টারচেঞ্জ থেকে দক্ষিণ অঞ্চলের অন্তত ১৬ জেলার যানবাহন আটকা পড়ে।

ভাঙ্গা থেকে দুইটি ইউনিয়নকে পৃথক করা সিদ্ধান্ত কিছুতেই মানবেনা ভাঙ্গাবাসী বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। এটি একটি হটকারি সিদ্ধান্ত বলেও মন্তব্য করেন ওই সময় ভাঙ্গা থানার আন্দোলনকারী জনগণ।

বিক্ষোভকারীরা এতোটাই ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, কাউকে কাউকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে, কেউ চিৎকার করে বলতে থাকেন মরে যাবো তবুও ভাঙ্গা থেকে আলাদা হবোনা। এসময় ভাঙ্গা থানার আলগী ইউনিয়নের সোনাখোলা এলাকার কিছু বিক্ষোভকারী জনগণ বলেন, ভাঙ্গা পৌরসভা সীমানার সাথে লাগানো ভাষা উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি ইউনিয়ন ভাঙ্গা থেকে আলাদা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসময় ইসি'র এমন সিদ্ধান্তকে কোনো অজানা শত্রুর গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।

আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খাওয়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. রোকিবুজ্জামান 'দৈনিক বাংলা ৭১'কে জানান, 'আজ (শুক্রবার) সকাল ৮টা থেকে ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়কের ফরিদপুর থেকে ভাঙ্গা ইন্টারচেঞ্জ পর্যন্ত মহাসড়কের দুটি পয়েন্ট পুখুরিয়া বাসস্ট্যান্ডে ও হামিরদী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল করছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও ঢাকা মাওয়া-ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কের ভাঙ্গা ইন্টারচেঞ্জ থেকে গোপালগঞ্জ মহাসড়কের মুনসুরাবাদ বাসস্ট্যান্ড অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

হাইওয়ে ওসি আরও জানান, ভাঙ্গার দুইটি ইউনিয়ন বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছেন ভাঙ্গার থানার বাসিন্দারা। স্থানীয়রা পুলিশকে জানিয়েছেন, তাদের দাবি না পূরণ হওয়া পর্যন্ত তারা মহাসড়ক থেকে সরবেন না। এতে প্রায় ৪ ঘন্টা ধরে মহাসড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। তবে ভাঙ্গা থানা ও হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের বোঝানোর চেষ্টা করেও তাদের রাস্তা থেকে সরানো যায়নি। সময়ের ব্যবধানে বিক্ষোভ মিছিল বড় হতে থাকে। ভাঙ্গাবাসীর অভিযোগ, 'আমাদের গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে আমাদের মা-মাটিকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র চলছে। এ ঘটনা আমরা কোনোভাবেই মানবো না। তাদের দাবি পুনরায় তাদের গ্রাম ভাঙ্গা উপজেলার মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এবং এটি দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে আগামীতে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা

এসবের মধ্যে বেলা ১২ টার দিকে, ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে পৌছে আন্দোলনকারীদের আশ্বাস দেন যে, অতি শীঘ্রই ভাঙ্গাবাসীর দাবি পুনর্বিবেচনা করার ব্যাপারে প্রশাসনের উর্ধতন কর্তাব্যক্তিদের সাথে কথা হয়েছে, তাঁরা আশ্বস্ত করেছেন। আপনারা রাস্তা ছেড়ে দিন, আমি আপনাদের সাথে আছি।' এসময়, 'তাদের মধ্যে এসব বিষয়ে আরও বেশকিছু কথাবার্তার পর বিক্ষোভকারীরা কিছুটা সন্তুষ্ট হলে মহাসড়ক ছাড়েন ভাঙ্গাবাসী। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চারঘন্টা পর যান চলাচল পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়। মুক্ত হয় ভাঙ্গার দিয়ে চলাচল করা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্তত ১৬ জেলার আটকে থাকা জনগণ।

তবে, তা বেশিক্ষণ স্থানী হয় না। মাত্র চার ঘন্টা বিরতি'র পর শুক্রবার বিকেল ৪টা থেকে আবারও সড়ক অবরোধ শুরু করে ভাঙ্গার আলগী ইউনিয়নের জনগণ। এবার তাদের সাথে যোগ দেয় হামিরদী ইউনিয়নসহ ভাঙ্গাকে পৃথক কারার সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ার পক্ষের স্থানীয়রা।

দ্বিতীয় দফা অবরোধ চলাকালে সন্ধ্যার ৬টার দিকে পুনরায় মহাসড়ক অবরোধের ব্যাপারটি নিশ্চিত করে ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. রোকিবুজ্জামান 'দৈনিক বাংলা ৭১'কে বলেন,'বিকেল চারটা থেকে এখন পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে আলগী ইউনিয়নের জনগণ সহ এলাকাবাসী। তিনি জানান, ভাই সকালের আন্দোলনকারীদের সাথে তবু কথা বলা গেছে, এদের সাথে তো কথাই বলা যাচ্ছেনা। এদের সবাই নেতা এবং সংখ্যায়ও অনেক বেশি। জানিনা কি হবে, আমি আমার উপরস্থ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করেছি। চেষ্টা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে।' এ বিষয়ে ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন 'দৈনিক বাংলা ৭১'কে প্রায় একই বক্তব্য প্রদান করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তাদের আশ্বাস ছাড়া মহাসড়ক ছাড়বেন না বলে জানান বিক্ষোভকারীরা। এতে আবারও ভাঙ্গা মহাসড়কে আটকা পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্তত ২০ জেলার এসময় চলাচলকারী যান বাহনের যাত্রীরা।

এদিকে আলগী ইউনিয়ের সাথে হামিরদী ইউনিয়নের হাসামদিয়া এলাকার কিছু লোকজন একটি বাস ভাঙচুর করে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সেখানে সংঘর্ষে ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। এই আন্দোলনের রক্ত ঝরে জনতার। তবে প্রাথমিকভাবে আহতদের সংখ্যা ও নাম পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।

এমপরিস্থিতিতে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা সাথে কথা বলে জানা যায়, ভাঙ্গায় দ্বিতীয় দফায় মহাসড়কের ওপর এমন বিক্ষোভ ও আন্দোলন থামাতে বিকেল পাঁচটার পর থেকে দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করেন ভাঙ্গা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমান। অবরোধস্থলে এসে জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে অবরোধ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছেন তিনি। ইউএনও বলেন, 'আমি আপনাদের দাবির পক্ষে সব ব্যবস্থা করছি, আপনাদের দাবি শীঘ্রই পুরণ হবে।' ইউএনও মিজানুর রহমান বিষয়টির সমাধানের জন্য মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় চেয়ে বলেন, 'আমাকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিন আপনারা, এর মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।'

তবে, উপস্থিত জনতা ইউএনও'র আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তাদের অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখেন। এমন পরিস্থিতির একপর্যায়ে ইউএনও আন্দোলনকারীদের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয় কয়েকজনকে ডেকে আলাদা কথা বলে ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। পরে আন্দোলনকারীদের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয়রা ফিরে এসে আন্দোলনকারীদের আস্বস্ত করে বুঝিয়ে বললে তারা তাদেরকেও স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় কিন্তু দেওয়া হবেনা। এরই মধ্যে সন্ধ্যা প্রায় ৬টার দিকে সড়কে অন্ধকার নেমে এলে ও বৃষ্টি শুরু হলে ধীরে ধীরে অবরোধকারীরা মহাসড়ক ছেড়ে চলে যেতে দেখা যায়। মহাসড়ক ছাড়ার আন্দোলনকারীদের অনেককেই বলতে শোনা, 'ভাইডি! সময় কিন্তু ৪৮ ঘন্টা-ই দিবানে!'

ভাঙ্গাবাসীর দ্বিতীয় দফার মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলনটি স্থগিত হলে শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে পুনরায় এক্সপ্রেসওয়ে সহ ভাঙ্গা চৌরাস্তার থেকে চারটি মহাসড়কেই যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ছড়াকার।