রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের লাঙলদাড়িয়া গ্রামের সাইকেল মিস্ত্রী অনিমেষ সরকার হত্যা মামলার প্রধান আসামি অহিদ মল্লিক ওরফে অহিদুজ্জামান মল্লিক গত ৮ জুলাই থেকে সাতক্ষীরা কারাগারে বন্দি রয়েছেন। গত দুই মাসেও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আদালতে রিমান্ডের আবেদন না জানানোয় নিহতের পরিবার হত্যার রহস্য উন্মোচন নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। তারা ন্যায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। 

সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, জমির সীমানা নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে সাতক্ষীরার আশাশুনী উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের লাঙ্গলদড়িয়া গ্রামের ওমর সিদ্দিক মল্লিকের ছেলে ইউনিয়ন বিএনপি'র আহবায়ক মালেক মল্লিক ও আর ভাই অহিদ মল্লিক ও মালেক মোল্লার ছেলে আলম মোল্লার সাথে দীর্ঘদিন ধরে জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল একই গ্রামের নিরঞ্জন সরকারের ছেলে সাইকেল মিস্ত্রি অনিমেষ সরকারের। এরই জের ধরে চলতি বছরের ২৪ শে জানুয়ারি রাতে দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনিমেষকে তার কাঁকড়ার ঘের থেকে অপহরণ করে হত্যার পর লাশ হাফ কিলোমিটার দূরে ইমদাদুল হকের নিম গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ২৫ শে জানুয়ারি নিহতের মা শেফালী রানী সরকার বাদী হয়ে কারো নাম উল্লেখ না করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় তাদের সঙ্গে মালেক মল্লিক, অহিদ মল্লিক ও আলম মোল্লার জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে ঘটনার আগের দিন মারপিট ও জীবননাশের হুমকির কথা উল্লেখ করা হয়।

মামলার এক নম্বর সাক্ষী বাবুল আক্তার মোল্লা জিজ্ঞাসাবাদে সে অনিমেষকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। ২৬ শে জানুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে সে মালেক মল্লিক, তার ভাই ওহিদ মল্লিক ও আলম মোল্লা সাইকেল মিস্ত্রি অনিমেষ সরকারকে হত্যার ঘটনায় কে কিভাবে দায়িত্ব পালন করেছিল তা বিস্তারিত উল্লেখ করে। যে কারণে মালেক মল্লিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আদালতে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত মালেক মল্লিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ড মনজুর করে। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মালেক মল্লিকের কাছ থেকে অনিমেষ হত্যার ঘটনায় কোন ক্লু উদ্ধার করতে পারিনি। এমনকি আত্মগোপনে থাকা অজিত মল্লিককেও পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে বাবুল আক্তার মোল্লা মহামান্য হাইকোর্ট থেকে গত ২২ এপ্রিল, ও মালেক মল্লিক গত ২৪ শে মে জামিন লাভ করেন।

আদালত সূত্রে আরো জানা গেছে চলতি বছরের পহেলা জুন ওহিদ মল্লিক মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি আখতারের আদালত থেকে পায়ের সপ্তাহের জন্য অন্তবর্তী কালীন জামিন লাভ করেন সে অনুযায়ী আদালতের নির্দেশে অহিদ মল্লিক গত ৮ ই জুলাই সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন। বিচারক শুনানি শেষে জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এদিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে অনিমেষ সরকারকে নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে করে হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে নিরঞ্জন সরকারের অভিযোগ,তার ছেলে অনিমেষ সরকারকে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতারকৃত মালেক মল্লিক এর কাছ থেকে হত্যার কোনো কুলু উদ্ধার করতে পারেননি। উপরন্তু অহিদ মল্লিক হত্যার মূল নায়ক হলেও গত দু'মাস ধরে কারাগারে থাকা ওই আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ কোন রিমাণ্ড আবেদন জানায়নি।মামলার আসামি অহিদ মল্লিক প্রভাবশালী হওয়ায় বিশেষ সুবিধা নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা আমাদের জন্য রিমান্ড আবেদন জানানো হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আশাশুনি থানার উপ পরিদর্শক ফিরোজ হোসেন শনিবার সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদকে জানান, রাত দশটার দিকে ফোন করলে তিনি কাগজপত্র দেখে বিস্তারিত জানাবেন। শনিবার রাত দশটা ও রবিবার কয়েক দফায় তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

প্রসঙ্গত, বাবুল আক্তার মোল্লা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেও অনিমেষের লাশ ইমদাদুল হকের নিম গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল কারা তা জানা যায়নি।

জবানবন্দিতে বাবুল আক্তার মোল্লা উল্লেখ করেছেন যে, তাদের গ্রামের ওমর ছিদ্দিক মল্লিকের ছেলে আব্দুল মালেক মল্লিক, তার ভাই অহিদ মল্লিক ও একই গ্রামের মালেক মোল্লার ছেলে আলম মোল্লার সাথে তার দীর্ঘ দিনের সখ্যতা। ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার রার সাড়ে সাতটার দিকে স্থানীয় রব্বানির দোকানে তিনিসহ ওমর ছিদ্দিক মল্লিকের ছেলে অহিদ মল্লিক ও মালেক মোল্লার ছেলে আলম চা খাচ্ছিলেন। এ সময় অহিদ মল্লিকের বড় ভাই শ্রীউলা ইউনিয়ন বিএনপি’র আহবায়ক মালেক মল্লিক মোবাইল ফোনে তাদের তিনজনকে তাদের বাড়িতে যেতে বলেন। সে অনুয়ায়ি রাত ৮টার দিকে তারা তিনজন মালেক মল্লিকের বাড়িতে যান। মালেক মল্লিক তাদেরকে ডেকে নিয়ে ঘরের পিছনে যান। সেখানে মালেক বলেন যে, তার দল বিএনপি এখন ক্ষমতায়।

নিরঞ্জন সরকারের ছেলে অনিমেষের কথা সহ্য করা যাচ্ছে না। তাকে আজ রাতেই শেষ করে দিতে হবে। তিনি (বাবলু) রাজী না হওয়ায় মালেক মল্লিক তার হাতে থাকা দা তার (বাবলু) গলায় ধরেন। একপর্যায়ে তারা তিনজনসহ মালেক মল্লিক অনিমেষের ঘেরের পাশে একটি খেজুরগাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে ঘেরের পাশে আসা মাত্রই ইমদাদুলের সবজি খেতের পাশে অহিদ মল্লিক পিছন দিক থেকে অনিমেষকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় আলম মোল্লা অনিমেষের দুই হাত চেপে ধরেন। অহিদ অনিমেষের গলায় দুই হাত চেপে ধরে মেরে ফেলে। এ সময় মালেক মল্লিক তার গলায় দা ধরে দাঁড়িয়েছিল। মালেক তাকে বলে যে, একথা কাউকে জানালে তার পরিস্থিতি (বাবলু) অনিমেষের মত হবে।

একপর্যায়ে তারা চারজন নাকতাড়া বাজারে জিল্লুর চায়ের দোকানে যেয়ে চা খান। সেখান থেকে তিনি বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়লেও ঘুম আসছিলো না। একপর্যায়ে একটি ঘুমের বাড়ি খেয়ে তিনি অবারো শুয়ে পড়েন। ২৫ জানুয়ারি সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখতে পান ইমদাদুল হকের নিম গাছে নাইলনের দড়ি গলায় বেঁধে অনিমেষের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া তার বাড়ির ছাদে অনিমেষের ব্যবহৃত একটি শট প্যান্ট, একটি লাইটার, মানি ব্যাগসহ কিছু জিনিসপত্র ফেলে রাখা হয়েছে। নিম গাছে অনিমেষকে ঝুলিয়ে রাখা নাইলনের দড়িটি ছিলো আলম মোল্লার। তাকে ফাঁসানোর জন্য মালেক মল্লিক ও অহিদ মল্লিক পরিকল্পিতভাবে তার বাড়ির পাশে নিম গাছে অনিমেষের লাশ ঝুলিয়ে রাখে ও তার বাড়ির ছাদে অনিমেষের শট প্যান্ট, গ্যাস লাইটার, মানিব্যাগসহ কিছু জিনিসপত্র ফেলে রাখে।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২৫)