আবীর আহাদ


বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কখনও কখনও জাতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নেতাদের অবমাননার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এ শ্রেণির অন্যতম হলেন শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী ড. সলিমুল্লাহ খান, যিনি প্রকাশ্য ও কখনও কখনও পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করে আসছেন। তাঁর এমন আচরণকে আমরা কেবল ব্যক্তিগত মতের সমস্যা বলে দেখছি না, বরং এটি জাতীয় ঐক্য ও সাংস্কৃতিক চেতনার বিরুদ্ধে একটি সিস্টেম্যাটিক ষড়যন্ত্রই শুধু নয়- জাতির স্বাধীনতা ও বাঙালি-চেতনাবিরোধী অপশক্তির সাথেও তাঁর অবস্থানের মিল খুঁজে পাওয়া যায়!

বঙ্গবন্ধুবিরোধী মনোভাব: ইতিহাসের বিকৃতি

ড. সলিমুল্লাহ খান বারবার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও মানবিক কৃতিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতা নন, তিনি জাতির পিতা, যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, (যা ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বলা হয়েছে):

“আমরা, বাংলাদেশ জনগণ, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করিয়া এই সংবিধান প্রণয়ন করিলাম।”

এই ঐতিহাসিক ও সংবিধানিক স্বীকৃত সত্যকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ছোট করা মানে স্বাধীনতার চেতনাকে অস্বীকার করা। আরও উদ্বেগজনক হলো, তাঁর বক্তব্য কেবল যুক্তিতর্ক বা তাত্ত্বিক সমালোচনা নয়, এটি বরং একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আক্রমণ।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ওপর কালিমা লেপন

ড. সলিমুল্লাহ খানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে দাবি করা হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। এটা বঙ্গবন্ধুকে হেয় ও স্বাধীনতা ঘোষণার ওপর কালিমা লেপন ছাড়া কিছু আর কিছু নয়। তাঁর এ বক্তব্য কেবল বিভ্রান্তিকর নয়, সরাসরি ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টাও বটে। যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে বহু গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। আমার রচিত ১৯৯৪ সালে বইমেলায় প্রকাশিত বেস্টসেলার গ্রন্থ "বঙ্গবন্ধুবিরোধী মিত্থাচার: বাংলাদেশের রাজনীতি"তে দলিলভিত্তিক দু'টি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজিত আছে, যা স্বাধীনতা ঘোষণার অন্যতম প্রধান সাক্ষ্য বলেও বিবেচিত হতে পারে। তাতে রয়েছে:

"১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা “অপারেশন সার্চলাইট” নামে বর্বর গণহত্যা শুরু করে। এর প্রতিবাদে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক, যিনি সে সময় ঢাকার ওয়ারলেস, রেডিও ও টেলিভিশনের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর রচিত গ্রন্থ "Witness to Surrender" (Karachi, Oxford University Press, 1977, p.75)-এ লিখেছেন:

" When the first shot had been fired, the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through a wavelength close to that of official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like a prerecorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People's Republic of Bangladesh".

অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে শেখ মুজিবকে “পাকিস্তানের শত্রু” আখ্যা দেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ তোলেন। আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাতিল করা হয়।"

১. ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করার মুহূর্তে, তিনি ওয়ারলেসে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের জন্য: " এটিই সম্ভবত: আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন- জয় বাংলা।" বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা তৎকালীন ইপিআর, পুলিশসহ হানাদার বাহিনীর রেডিও ও ওয়ারলেসেও ধরা পড়ে, যার বিবরণও দিয়েছেন পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক।

২. বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে সেই ঘোষণাটি প্রথম প্রচারিত হয় চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র (পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) থেকে। এম.এ. হান্নান, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা, ২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর বার্তা পাঠ করেন, “আমি, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।”

৩. মেজর জিয়া ২৭ মার্চ কালুরঘাট একই বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করেন: I, major Zia, do here by proclaimed the independence of Bangladesh on behalf of our Great National Leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman.. Jai Bangla"

৪. স্বাধীনতার ঘোষণার প্রমাণস্বরূপ বহু আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা (যেমন এএফপি, বিবিসি, রয়টার, এবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও মস্কো, হিন্দুস্তান টাইমস) ২৬-২৭ মার্চেই খবর প্রকাশ করে যে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।

৫. বাংলাদেশের সংবিধান ও ১৯৭২ সালের জাতীয় সংসদে গৃহীত প্রস্তাবনাতেও বঙ্গবন্ধুকেই স্বাধীনতার স্থপতি ও ঘোষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

অতএব, “শেখ মুজিব ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি”—এমন বক্তব্য দিয়ে লেখক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক বদরুদ্দীন উমরসহ যেসব জ্ঞানপাপী এ-জাতীয় মিত্থাচার ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন তা ইতিহাসের সাথে নিষ্ঠুর প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং তাঁর নেতৃত্বের ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে।

রবীন্দ্রনাথ বিরোধী মনোভাব: সাংস্কৃতিক আত্মঘাতিতা

কেবল বঙ্গবন্ধু নয়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ড. সলিমুল্লাহ খান টার্গেট করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও মানবতাবাদ বাঙালি জাতীয় চেতনার মূল ভিত্তি। তিনি জাতির আত্মার প্রতীক। তাঁকে ছোট করার মানে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবমূল্যায়ন। ড. সলিমুল্লাহ খানের বিতর্কিত বক্তব্য, যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রগতিশীলতা ও মানবিক চেতনার স্বীকৃত মূল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে তাঁর “বুদ্ধিজীবিতা” প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতির আত্মঘাতী প্রচেষ্টা।

উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিভ্রান্তি

ড. সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায় যে, কোনো জাতীয় ঐক্যের প্রতীককে আঘাত করাই তাঁর মূল লক্ষ্য। তিনি নিজেকে ‘মুক্তচিন্তার যোদ্ধা’ দাবি করেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর এ কথিত মুক্তচিন্তা অবমাননা, বিভ্রান্তি ও ইতিহাস বিকৃতির ছদ্মবেশ। বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলি এ ধরনের বুদ্ধিজীবীর সহায়তা পেতে পছন্দ করে, কারণ তারা জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যকে ব্যর্থ ও বিভ্রান্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করে।

দলিলভিত্তিক সমালোচনা

১. সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ: বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার অর্জন স্পষ্ট। এ ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তি তাঁর অবদানকে ছোট করতে পারেন না।

২. সাহিত্য ও সংস্কৃতি: রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ও নাটক বাঙালি জাতীয় চেতনার অংশ, যা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি। তাঁকে অপমান করা মানে সাংস্কৃতিক আক্রমণ।

৩. জাতীয় ঐক্য: স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতি অবজ্ঞা জাতিকে দুর্বল করে এবং বহুদলীয় ষড়যন্ত্রকে উৎসাহ দেয়।

জাতির প্রতিরক্ষা জরুরি

ড. সলিমুল্লাহ খানের কর্মকাণ্ড কেবল ব্যক্তিগত মতের সমস্যা নয়; এটি জাতির ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত আক্রমণ। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার চেষ্টা জাতিকে বিভ্রান্ত করার ছদ্মবুদ্ধিজীবিতার সরাসরি প্রমাণ। বাংলাদেশকে এমন বিভ্রান্তিকর শক্তির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য এই ধরনের ছদ্মবুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন এবং সচেতনতারও প্রয়োজন।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।