চাটমোহর প্রতিনিধি : চার দফা দাবিতে এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও লাইন সচল রাখার দায়িত্ব নেওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গণছুটি কর্মসূচী পালন শুরু করছেন।

বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে তারা জোরদারভাবে গণছুটি কর্মসূচী পালন শুরু করেছেন। এতে বিদ্যুৎ সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৫১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৩১০ জন গণছুটিতে রয়েছেন বলে আন্দোলনকারীদের তথ্যে জানা গেছে।

চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, আটঘরিয়া, ঈশ্বরদী এবং পাবনা সদর উপজেলা মিলিয়ে পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এ মোট গ্রাহক রয়েছে ৩ লাখ ৮০ হাজার জন।

উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টায় পাবনা জেলা প্রশাসক মফিজুল ইসলাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলকারী কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে তাদের দাবিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করেন। বৈঠকে জেলা প্রশাসকের কাছে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে একটি লিখিত আবেদন দেওয়া হয়। সেই লিখিত পত্রে পল্লী বিদ্যুৎ সিস্টেমে বিরাজমান অস্থিরতার বিষয়ে অবহিতকরণ এবং সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আবেদন জানানো হয়।

গণছুটি কর্মসূচী পালন করা পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পল্লী বিদ্যুৎ সিস্টেমের সংস্কার ও আরিইবি’র শোষণ, নিপীড়ন এবং নিম্নমানের মালামাল থেকে মুক্তির লক্ষে চার দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা।

দাবিগুলো হলো ১. আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের গঠিত দুইটি কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন (আরইবি-পিবিএস একীভূতকরণ বা অন্যান্য বিবরণ সংস্কার ন্যায় কোম্পানী গঠনের সুপারিশ প্রনয়ণ, সকল চুক্তিভিত্তিক অনিয়মিত (মিটার রিডার কাম মেসেঞ্জার, লাইন শ্রমিক ও পৌষ্য বিলিং সহকারী কর্মীদের নিয়মিতকরণ, মামলা প্রত্যাহার পূর্বক চাকরীচ্যুতদের স্বপদে পুনর্বহাল, সকল সংযুক্ত ও সাময়িক বরখাস্তকৃত এবং অন্যায়ভাবে বদলিকৃতদের পদায়ন) দাখিল এবং বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রকাশ করতে হবে।

২. ১৭ আগস্ট’২০২৫ থেকে অদ্যাবধি হয়রানীমুলকভাবে বরখাস্তকৃত ও সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরখাস্ত আদেশ বাতিলপূর্বক পূবের কর্মস্থলে পদায়ন করতে হবে।

৩. জরুরী সেবায় নিয়োজিত লাইন ক্রুদের কর্মঘন্টা নির্ধারণ এবং শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচীকালীন যোগদান করতে না পারা পাঁচজন লাইনক্রুকে পূর্বের কর্মস্থলে যোগদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

পাবনা জেলা প্রশাসকের কাছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুুৎ এসোসিয়েশন (বাপবিএ) এর দপ্তর সম্পাদক মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়েছে, আরইবি’র দ্বৈতশাসন ও শোষণ, নিপীড়ন থেকে মুক্তি এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মানসম্মত বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিতের লক্ষে দেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ২০২৪ সালের জানুয়ারী থেকে আন্দোলন করে আসছেন। তার প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক ওই বছরের ২৩ অক্টোবর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সভাপতি করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ ৮ মাসেও সেই কমিটি প্রতিবেদন দাখিল না করায় পুনরায় শহীদ মিনারে ১৬ দিনব্যাপী আন্দোলেনের পর প্রতিবেদন দাখিল হয়। এরপর বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক ২০২৫ সালের ১৭ জুন আবারো উচ্চ পর্যায়ের দুইটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তারপরও দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও সহজ ও স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য কোনো একটি বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান হয়নি।

এছাড়া বিদ্যুৎ খাত সংস্কার কমিটির তদন্তে প্রমাণিত নিম্নমানের মালামাল ক্রয়ের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া স্বত্ত্বেও আরিইবি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শুধুমাত্র দমন-পীড়ন এবং হয়রানীর উদ্দেশ্যে গত ১৭ আগস্ট থেকে বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ট্যান্ডরিলিজ পূর্বক বরখাস্ত করা হয়েছে। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সংযুক্ত করা হয়েছে। ১৭ থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত সমিতির ২৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত এবং ৬ জন কর্মচারীকে চাকরীচ্যুত করা হয়।

ফলে বাধ্য হয়ে গ্রাহকসেবা চালু রেখে ৩১ আগস্ট থেকে দেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি চার দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচী পালন শুরু করে। চলমান আন্দোলনের মাঝেও সমাধানের আন্তরিক না হয়ে ২ জন কর্মচারীকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুতেএবং ৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্ট্যান্ডরিলিজপূর্বক বরখাস্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য এই আন্দোলনের কারণে এখন পর্যন্ত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ১৭২ জনের নামে দেশদ্রোহী মামলা, ২০ জনকে জেল খাটানো, ৩৬ জনকে চাকরীচ্যুত, শতাধিক বরখাস্ত ও সংযুক্ত এবং সাড়ে ৬ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হয়রানীমুলক বদলী করা হয়েছে।

আবেদনে আরো জানানো হয়, গত ৩১ আগস্ট থেকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচী পালন এবং পরবর্তীতে ৪৮ ঘন্টা সময় দেওয়া হলেও, বিদ্যমান সংকট সমাধানের কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ না করায় গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গণছুটি কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে। গণছুটিতে থাকা স্বত্ত্বেও জনভোগান্তির কথা বিবেচনা করে লাইন ক্রুগণ উপকেন্দ্র সহ গ্রাহকসেবা সচল রেখেছিল। তারপরও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) স্থানীয় ইলেক্ট্রিশিয়ান, ঠিকাদার এবং আরইবির নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে লাইন চালু রাখার বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগকে অবহিত করায় সমিতির কারিগরি জনবলের প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিক্ষুব্ধ করা হয়েছে। তাই সমিতির সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী জোরদারভাবে গণছুটি কর্মসূচী পালন করছে। এর ফলে কোথাও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হলে তার দায়-দায়িত্ব পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে বহন করতে হবে।

পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল্লাহ আল আমিন চৌধুরী বলেন, ‘গতকাল বুধবার ১২১ জন গণছুটিতে ছিলেন। বৃহস্পতিবার ৮৭ জন গণছুটিতে আছেন। লোকবল কম হলে তো গ্রাহকসেবা দিতে সমস্যা হয়ই। তারপরও আমরা আমাদের সাধ্যমতো গ্রাহকসেবা নিশ্চিতে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে বৈঠক আছে। সেখানে কি সিদ্ধান্ত হয় দেখা যাক।’

এ বিষয়ে পাবনা জেলা প্রশাসক মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আজ পাবনা-১ ও পাবনা-২ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম সহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীদের আমি ডেকেছিলাম। তাদের সাথে আলোচনা করেছি। তাদের বলেছি আপনাদের কোনো দাবি থাকলে সেটা আমাদের জানান। আমরা সেটা মন্ত্রণালয়ে জানাবো যাতে আপনাদের দাবি পূরণ হয়। কর্মবিরতিতে না গিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখতে হবে। যাতে গ্রাহকদের ভোগান্তি না হয়। আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে।’

(এসএইচ/এসপি/সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫)