ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর বিশ্ব সেপসিস দিবস পালিত হয়। এই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো সেপসিস সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি করা, রোগটি দ্রুত শনাক্ত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা এবং যথাসময়ে চিকিৎসা নিশ্চিত করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও গ্লোবাল সেপসিস অ্যালায়েন্সের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি ৮৯ লাখ মানুষ সেপসিসে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মৃত্যুবরণ করেন। এটি পৃথিবীর মোট মৃত্যুর প্রায় ২০%। অর্থাৎ পৃথিবীতে কয়েক সেকেন্ড অন্তর অন্তর একজন মানুষের মৃত্যু ঘটে সেপসিসের কারণে।

শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি বছর প্রায় প্রায় ১ কোটি শিশু (৫ বছরের নিচে) সেপসিসে আক্রান্ত হয়। ২০২৪ সালের একটি পর্যালোচনায় বলা হয়, বিশ্বে সেপসিস-সম্পর্কিত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে—কেবলমাত্র জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা–জনিত সেপসিসেই প্রায় ১ কোটি ৩৭ লাখ মৃত্যু ঘটে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সেপসিস একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি। ঢাকার –এর গবেষণা অনুযায়ী, শিশুদের সেপসিসের ঘটনা ও মৃত্যু পরিবেশগত পরিবর্তন যেমন তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। যখন তাপমাত্রা প্রায় ২৬.৬ °C থেকে ২৮ °C–এর মধ্যে থাকে, তখন সেপসিস তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। অপরদিকে বেশি তাপমাত্রা ও অতিরিক্ত বৃষ্টির সময় শিশুদের সেপসিস ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া বাংলাদেশে আইসিইউ–তে ভর্তি রোগীদের মধ্যে এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৪১% রোগী সেপসিসে আক্রান্ত।তাই বিশ্ব সেপসিস দিবস শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জরুরি আহ্বান।

সেপসিস কী?

সেপসিস হলো এমন একটি প্রাণঘাতী অবস্থা যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই প্রতিক্রিয়ায় শরীরের টিস্যু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। সহজভাবে বলা যায়—সংক্রমণ থেকে উদ্ভূত এক ধরনের সিস্টেমিক প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া, যা নিয়ন্ত্রণহীন হলে অঙ্গ বিকল এবং মৃত্যু ঘটায়।

আগে সেপসিসকে অনেকে “রক্তে জীবাণু সংক্রমণ” বা “রক্ত বিষক্রিয়া” বলে চিনতেন। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে সেপসিসকে শুধু রক্ত সংক্রমণ হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে এটিকে একটি জটিল সিস্টেমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

সেপসিসের কারণ

সেপসিস সাধারণত কোনো প্রাথমিক সংক্রমণ থেকে শুরু হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণ হয়ে তা রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে পড়ে এবং রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এর প্রধান কারণগুলো হলো—

১. ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ – সবচেয়ে সাধারণ কারণ। যেমন নিউমোনিয়া, মূত্রনালি সংক্রমণ, ক্ষত সংক্রমণ ইত্যাদি।

২. ভাইরাস সংক্রমণ – ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, কোভিড-১৯ ইত্যাদি ভাইরাস সংক্রমণ থেকেও সেপসিস হতে পারে।

৩ . ছত্রাক সংক্রমণ – ইমিউনো-কমপ্রোমাইজড রোগীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

৪. পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণ – অ্যাপেন্ডিসাইটিস, পেরিটোনাইটিস বা অন্ত্রের ফোড়া থেকে সেপসিস হতে পারে।

৫. প্রসূতি সংক্রমণ – গর্ভাবস্থা, প্রসবকালীন বা প্রসবোত্তর জটিলতায় সেপসিসের ঝুঁকি থাকে।

৬. অস্ত্রোপচার বা হাসপাতালজনিত সংক্রমণ – সার্জারি-পরবর্তী ইনফেকশন সেপসিসের বড় কারণ।

লক্ষণ

সেপসিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো অনেক সময় সাধারণ সংক্রমণের মতো মনে হতে পারে। তবে দ্রুত তা জটিল রূপ নেয়। প্রধান লক্ষণগুলো হলো—

* শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া * দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস * অতিরিক্ত ঘাম ও দুর্বলতা * বিভ্রান্তি, অস্থিরতা বা অস্পষ্ট চেতনা * রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া * প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া * শরীরের ত্বক ফ্যাকাশে বা দাগযুক্ত হওয়া।বিশেষ করে নবজাতক, শিশু, গর্ভবতী নারী, বয়স্ক ও দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা জরুরি।

প্রকারভেদ

সেপসিসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—

১. সেপ্টিসেমিয়া – যখন জীবাণু রক্তে প্রবেশ করে এবং রক্তে ছড়িয়ে পড়ে।

২. সেপসিস – সংক্রমণের ফলে শরীরজুড়ে প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া।

৩. সিভিয়ার সেপসিস – যখন সংক্রমণের কারণে একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।

৪. সেপটিক শক – গুরুতর সেপসিস, যেখানে রক্তচাপ মারাত্মকভাবে নেমে যায় এবং শারীরিক অঙ্গগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

৫. নিউনেটাল সেপসিস – নবজাতকের মধ্যে জন্মের পর সংক্রমণজনিত জটিলতা।

৬. সার্জিকাল সেপসিস – অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সংক্রমণজনিত সেপসিস।

রোগ নির্ণয়

সেপসিস দ্রুত শনাক্ত করা জীবনরক্ষাকারী। রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকেরা সাধারণত নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো করেন—

* শারীরিক পরীক্ষা – তাপমাত্রা, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ।

* রক্ত পরীক্ষা – রক্তে সংক্রমণ ও প্রদাহের সূচক নির্ণয়।

* কালচার টেস্ট – রক্ত বা প্রস্রাবে জীবাণু সনাক্ত।

* চিত্রায়ণ পরীক্ষা – এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, সিটি-স্ক্যান বা এমআরআই করে সংক্রমণের উৎস খোঁজা।অক্সিজেন ও কিডনির কার্যকারিতা মূল্যায়ন – রক্তে অক্সিজেন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রম বোঝার জন্য।

জটিলতা

সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে সেপসিসের ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:-
* কিডনি, লিভার, ফুসফুসসহ একাধিক অঙ্গ বিকল হওয়া * মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে কোমা হওয়া * রক্তচাপ স্থায়ীভাবে নিচে নেমে যাওয়া * শ্বাসকষ্ট ও ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন * দীর্ঘমেয়াদী অঙ্গ অকার্যকারিতা * মৃত্যু

প্রতিকার

সেপসিসের চিকিৎসায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণই জীবন বাঁচানোর মূল চাবিকাঠি। চিকিৎসার ধাপগুলো হলো—

১. অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি – সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ওষুধ প্রয়োগ।

২. তরল সরবরাহ – রক্তচাপ বজায় রাখতে স্যালাইন বা তরল সরবরাহ করা হয়।

৩. অক্সিজেন থেরাপি – রোগীর শ্বাসকষ্ট কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।

৪. অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সহায়ক চিকিৎসা – কিডনি বিকল হলে ডায়ালাইসিস, শ্বাসকষ্টে ভেন্টিলেটর।

৫. সংক্রমণের উৎস দূরীকরণ – যেমন পুঁজ বের করা বা সংক্রমিত অঙ্গ অপসারণ।

৬. নিবিড় পরিচর্যা – গুরুতর রোগীদের আইসিইউতে রাখা হয়।

প্রতিরোধ

সেপসিস প্রতিরোধযোগ্য রোগ। প্রতিরোধের কিছু উপায় হলো—* সময়মতো সংক্রমণ শনাক্ত ও চিকিৎসা * অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে জীবাণুনাশক ব্যবস্থা * গর্ভবতী নারীদের যথাযথ প্রসূতি সেবা * নবজাতকের পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ সেবা * অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার (অতিরিক্ত ব্যবহার নয়) * টিকাদান কর্মসূচি ও স্বাস্থ্যবিধি মানা

বিশ্ব সেপসিস দিবসের গুরুত্ব

বিশ্ব সেপসিস দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সেপসিস কেবল চিকিৎসকদের কাছে সীমাবদ্ধ কোনো বিষয় নয়; বরং এটি একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা। সচেতনতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়ন ও গবেষণা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। বিভিন্ন দেশে এ দিবসে সেমিনার, প্রচারাভিযান, চিকিৎসক প্রশিক্ষণ ও গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালিত হয়। বাংলাদেশেও হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোতে আলোচনাসভা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, সেপসিস একটি নীরব ঘাতক রোগ, যা অতি দ্রুত জীবনকে গ্রাস করতে সক্ষম। একটি সাধারণ সংক্রমণ অবহেলা বা দেরি করলে মুহূর্তেই ভয়াবহ আকার নিতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিসংখ্যান বলছে—বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর লাখো মানুষ সেপসিসে আক্রান্ত হয় এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করে। তাই বিশ্ব সেপসিস দিবস আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। সংক্রমণ কখনোই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না, বরং শুরু থেকেই সচেতনতা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, টিকা গ্রহণ, সময়মতো রোগ নির্ণয় ও যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সঠিক সময়ে চিকিৎসককে দেখানো এবং হাসপাতালে ভর্তি করা জীবন বাঁচাতে পারে। পাশাপাশি পরিবারে সচেতনতা, সমাজে স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই সেপসিস প্রতিরোধের কার্যকর উপায়। মনে রাখতে হবে—একসাথে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া এবং প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করলেই কেবল এই প্রাণঘাতী রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব।

লেখক: চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।