আবীর আহাদ


বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশী প্রভাব একটি আলোচিত বাস্তবতা। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ ওঠে, কোনো কোনো নেতৃত্ব নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক স্বার্থে দেশীয় জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে বিদেশী শক্তির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এরা মূলত বিদেশী রাষ্ট্রের অনুচর হিসেবে কাজ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আসল লাভ ও ক্ষতি কী?

সম্ভাব্য লাভ

১. অর্থনৈতিক সহায়তা: বিদেশমুখী নেতৃত্ব অনেক সময় আন্তর্জাতিক ঋণ, অনুদান বা প্রযুক্তিগত সহায়তা সহজে পেয়ে যায়। বিশ্বব্যাংক, IMF, ADB কিংবা আঞ্চলিক শক্তির দ্বিপাক্ষিক ঋণ----এসব মূলত রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার ওপর নির্ভর করে।

২. কূটনৈতিক সুবিধা: যে নেতৃত্ব কোনো শক্তিশালী দেশের ঘনিষ্ঠ হয়, তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমর্থন ও স্বীকৃতি পেতে সুবিধা ভোগ করে।

৩. শ্রমবাজার ও বাণিজ্য: বিদেশী শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে প্রবাসী শ্রমবাজার সম্প্রসারণ ও বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া সম্ভব হয়।

সম্ভাব্য ক্ষতি

১. সার্বভৌমত্বের ক্ষয়: বিদেশী অনুচরের নেতৃত্বে জাতীয় সিদ্ধান্ত জনগণের স্বার্থে নয়, বরং তাদের নিজেদের ও প্রভু রাষ্ট্রের স্বার্থে গৃহীত হয়। দেশের মধ্যে বিদেশী রাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি তৈরি করার অনুমতি দিতে হয়, যার ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব নস্যাতের পাশাপাশি প্রতিবেশীসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কলহ-বিবাদ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশীয় রাজনীতিতে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং স্বাধীন নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২. অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা: বিদেশী সহায়তার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা অর্থনীতিকে ঋণ-ফাঁদে ফেলে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

৩. অভ্যন্তরীণ বিভাজন: বিদেশপ্রীতি ও বিদেশবিরোধী দুই ধারায় রাজনীতি বিভক্ত হয়। এর ফলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়ে, জাতীয় ঐক্য ভেঙে যায়।

৪. অস্বচ্ছ চুক্তি: বিদেশী অনুচরের নেতৃত্বে অনেক সময় গোপন চুক্তি হয়, যেমন পানিবণ্টন, সীমান্ত, প্রতিরক্ষা বা বাণিজ্য চুক্তি, যা জনগণের কাছে স্বচ্ছ থাকে না।

৫. দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট: বিদেশ-নির্ভর শাসনব্যবস্থা বৈধতা হারায় এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। এ ধরনের নেতৃত্ব প্রায়শই স্বৈরাচার বা দুর্নীতির আবরণে ঢাকা থাকে।

ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত

স্বাধীনতার পরপরই ভঙ্গুর আর্থসামাজিক বাস্তবতায় ভারত ও সোভিয়েত প্রভাব ছিল প্রবল। এতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সহজ হয়েছিল, কিন্তু সমালোচকরা বলেন, নীতিনির্ধারণে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছিল।

সামরিক শাসনকালগুলোতে (যেমন জিয়া-এরশাদ আমল) পশ্চিমা শক্তি ও পাকিস্তানমুখী দৃষ্টিভঙ্গি সাময়িক সুবিধা আনলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুর্বল হয়েছিল।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে। একপক্ষকে অগ্রাধিকার দিলে অন্য পক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ।

বিশ্লেষণ: বিদেশী অনুচরের নেতৃত্ব অল্প সময়ের জন্য কিছু সুফল দিতে পারে, যেমন ঋণ, বিনিয়োগ বা স্বীকৃতি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি করে, কারণ এতে সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে, অর্থনীতি নির্ভরশীল হয় এবং রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল অর্জন হলো জাতীয় সার্বভৌমত্ব। সেই সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিয়ে কোনো বিদেশী অনুচরের নেতৃত্বে চলা মানে সাময়িক সুবিধার বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পথ বেছে নেয়া। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের একমাত্র সঠিক পথ হলো: স্বাধীন ও ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি, যেখানে দেশের জনগণই হবে নীতি-নির্ধারণের প্রধান শক্তি।

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক ও গবেষক।